আমি বললুম আশ্চর্য! বাঙলা ভাষা কী তাড়াতাড়ি তার ভোল বদলেছে! ভারতচন্দ্র এমনকি আলাল-হুঁতোম দু জনাই আপনার চেয়ে বেশি আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন। অবশ্য বেনামি লেখাতে বিদ্যেসাগর মশাই আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন হুতোমের চেয়ে কম। কিন্তু তিনিও যা করেছেন সেটা নগণ্য নয়। আজ যদি প্যারীচাঁদ, কালীপ্রসন্ন, বিদ্যেসাগর কলকাতায় নেমে আড্ডা জমান তবে তাই শুনে বোধ হয় আপনার হিন্দু ক্লাস-ফ্রেন্ডরা ভিরমি যাবেন। কাজেই আমার পরামর্শ যদি নেন তবে বলব, আপনার ভাষা বদলাবেন না। কেউ যদি মুখ টিপে হাসে, হাসুক। আমার অঞ্চলের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরাও অত্যন্ত সংস্কৃতঘন বাঙলা বলেন– যেমন হপ্তা দুত্তিন না বলে বলেন– পক্ষাধিককাল এবং তাই শুনে হিন্দু-মুসলমান উভয়ই কৌতুক অনুভব করে। তাতে কী যায়-আসে?
এমন সময় শহর-ইয়ার চিন্তাকুল ভাব নিয়ে সভাস্থলে উপস্থিত। শুধালেন, আপনার রেকর্ড-সঞ্চয়ন অদ্ভুত। আপনি বাছাই করেছিলেন কীভাবে?
আমি হেসে বললুম, কোনওভাবেই না। আমি বরোদায় ছিলুম ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৪। এই সময়টার মধ্যে যা রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বেরিয়েছে তাই কিনেছি– কোনওপ্রকারের বাছবিচার না করে। তার বহু বৎসর পর মোহরদি দু চারখানা রেকর্ড আমাকে দেয়– ব্যস্। ৪৪-এর পর, আজ পর্যন্ত, কোথাও ভালো করে আসন পেতে বসতে পারিনি। ফলে কলেকশন্টা বাড়াতে পারিনি। সে নিয়ে আমার কোনও মনস্তাপ নেই।
সাধের জিনিস ঘরে এনেই
এনে দেখি লাভ কিছু নেই।
খোঁজার পরে চলে আবার খোঁজা।
চলুন মাদাম, চলুন মসিয়ো ল্য দত্যোর,
দুইটি বস্তু প্রতি মানবেরে টানিতেছে বরাবর।
দানাপানি টানে একদিক থেকে অন্যদিকেতে গোর ॥
দো চিজ আদা কশদ জোর জোর।
য়কি আব ও দানা দিগর খাক্-ই-গোর
ওই তো এ বাড়ির দানা-পানির প্রতীক দিলবর জান সশরীরে উপস্থিত। আমি তার রান্নার প্রশংসা বা নিন্দা কিছুই করব না। আপনি শহর-ইয়ার বানু যখন এখানে রয়েছেন তখন আহারাদির জিম্মেদারি আপনার।
শহর-ইয়ার শুল্ক কণ্ঠে বললেন, আপনার রচনা সম্বন্ধে আলোচনা ট্যাবু; তার উল্লেখ না করে বলছি, আপনি খেতে ভালোবাসেন সেকথা আমি জানি, কিন্তু
আমি যেন আসমান থেকে পড়ে তার বক্তব্যে বাধা দিয়ে বললুম, আপনিও পেঁচি-টেপির মতো এই ভুলটা করলেন? লেখার সঙ্গে জীবনের কতখানি সম্পর্ক রবিঠাকুর নিদেন হাজারটি প্রেমের কবিতা লিখেছেন। অতএব, তিনি সমস্তক্ষণ প্রেমে পড়ার জন্য ছোঁক ছোঁক করতেন? সেই সুদূর ইয়োরোপে বসে মাইকেল কপোতাক্ষ-র স্মরণে কী যেন লিখেছেন– সতত পড় হে নদ আমার স্মরণে; ফিরে এসে সামান্যতম চেষ্টা দিয়েছিলেন এক ঘণ্টার তরেও ওই নদীর পারে যাবার! এ তো আমি চিন্তা না করেই বলছি। খুঁজলে এমন সব উদাহরণ পাবেন যে আপনার চক্ষুস্থির হয়ে যাবে। একাধিক কবি লিখছেন, আ মরি আ মরি গোছ প্লাতোনিক, দেহাতীত শিশির-বিন্দুর ন্যায় পূতপবিত্র স্বর্গীয় প্রেমের কবিতা– ওদিকে, তাঁদেরই একজন, হাইনে, বেরুতেন নিশাভাগে প্যারিসের কুখ্যাত– নেভার মাইন্ড, আপনি ডাক্তারের স্ত্রী, সহজে শফ্ট হবেন না–
এবং আমাদের বিয়ে হয়েছে দশটি বছর আগে, বললেন শহর-ইয়ার।
.
০৩.
এ কী! আপনি এখানে!
বাড়িটার একাধিক বারান্দা, তার একাধিক প্রান্তে একান্তে অন্তরালে বসে থাকা যায়। তারই একটাতে বসে আমি পূর্বাকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলুম। আজ কৃষ্ণপক্ষের ষষ্ঠী বা সপ্তমী, রাত প্রায় এগারোটা, একটু পরেই চাঁদ উঠবে, তারই আভাস লেগেছে তালের সারিতে। ঘরের ভিতরে শহর-ইয়ার রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাচ্ছিল। তার বাজানোর পদ্ধতিটা সত্যই বিদগ্ধ। একটা গান বাজানোর পর অন্তত মিনিট দশেক পর আরেকটা বাজায়। অনেকক্ষণ ধরে তার কোনও সাড়াশব্দ শুনতে পাইনি বলে ভেবেছিলুম সে বুঝি শুতে গেছে। ডাক্তার আমার ঘরে পেয়ে গেছেন নুরুনবের্ক মোকদ্দমার একখানা বই– যেটাতে যুদ্ধের সময় নাৎসি ডাক্তারদের অদ্ভুত অদ্ভুত এক্সপেরিমেন্টের পরিপূর্ণ বর্ণনা দেওয়া আছে। রাত দশটা বাজতে না বাজতেই তিনি সেই বই নিয়ে রাতের মতো উধাও।
শহর-ইয়ার বারান্দার নিভৃত প্রান্তে আমাকে আবিষ্কার করলেন।
আমি বললুম, ঠিক সময়ে এসেছেন। একটু পরেই চাঁদ উঠবে আর এই জায়গাটা থেকেই সে দৃশ্যটি সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। ডাক্তারের ঘরে তো এখনও আলো জ্বলছে; ওকে ডেকে আনুন না।
শহর-ইয়ার চুপ করে রইলেন। তার পর বললেন, শুনুন, আপনার সঙ্গে সোজাসুজি পরিষ্কার কথা হয়ে যাওয়াই ভালো। আমার স্বামীর অনুপস্থিতিতে কি আমার সঙ্গ পেলে আপনার অস্বস্তি বোধ হয়?
ঠিক ধরেছে। আমার বোঝা উচিত ছিল শহর-ইয়ারের বুদ্ধি এবং স্পর্শকাতরতা দুই-ই তীক্ষ্ণ। কিন্তু আমি এর উত্তর দেব কী?
আমি বললুম, না। কিন্তু তিনি যদি সেটা পছন্দ না করেন তবে আমি দুঃখিত হব।
শহর-ইয়ার বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আপনি তো জ্ঞানী লোক; আপনি তো বুঝলেন যে, তাঁর কোনও আপত্তি থাকলে তিনি আমাকে আপনার এখানে নিয়ে আসবেন কেন?
আমি বললুম, আমাদের এই বাঙলা দেশে মুসলমান মেয়েরা সবেমাত্র অন্দর মহল থেকে বেরিয়েছেন। এরা পরপুরুষের সঙ্গে কীভাবে মেলামেশা করবেন, কতখানি কাছে আসতে পারবেন এ সম্বন্ধে আমাদের কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই, থাকার কথাও নয়। ইয়োরোপে এ বাবদে মোটামুটি একটা কোড় তৈরি হয়ে গিয়েছে, কয়েক পুরুষের মেলা-মেশা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে। এই দেখুন না, কন্টিনেন্টের একটা মজার কোড়। নাচের মজলিসে কোনও বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে আমার আলাপ হল, কিন্তু পরিচয়টা তার স্বামী করিয়ে দেননি। এস্থলে আমি যদি মহিলাটির সহিত ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করি তবে লোকে আমাকে আর যা বলে বলুক ছোটলোক বলবে না। পক্ষান্তরে স্বয়ং স্বামী যদি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেন, এবং তারও বাড়া, যদি তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েদাইয়ে এবং তার পর যদি স্বামীর অজানতে আমি মহিলার সঙ্গে মেলামেশা আরম্ভ করি তবে সমাজ আমাকে বলবে ছোটলোক, নেমকহারাম। ভাবখানা এই, ভদ্রলোক তোমাকে বিশ্বাস করে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন, আপন স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, আর তুমি সেই বিশ্বাস ভঙ্গ করলে! আবার—