ডাক্তারটি স্বল্পভাষী। আমি শুধালুম, আপনি ডাক্তারির কী নিয়ে কাজ করছেন?
বললেন, এখনও ঠিক হদিস পাচ্ছিনে। ভাবছিলুম, যমজ, বামন এদের স্কেলিটেন নিয়ে।
আমি বললুম, ডক্টর ইয়াংকার যা নিয়ে–
তিনি অবাক হয়ে থমকে দাঁড়ালেন। শুধোলেন, আপনি জানলেন কী করে?
আমি বললুম, আপনারা দু জনাই বড় সরল আর কর্তাভজা। কর্তাভজা ইচ্ছে করেই বললুম। কর্তার গুণ আছে কি না চিন্তা পর্যন্ত করেন না। আপনি খুব ভালো করেই জানেন, আমি ডাক্তারির কিছুই জানিনে; অতএব ইয়াংকারকে চেনা আমার পক্ষে আকস্মিক যোগাযোগ বই আর কিছু না। বন শহরে আমি যখন পড়তুম তখন তিনি আমার প্রতিবেশী এবং আমার সংস্কৃতের অধ্যাপকের বন্ধু ছিলেন। মোটামুটি ওই সময়, অর্থাৎ ১৯৩৩/৩৪-এ তিনি পুরো মানুষের এক্সরে নেবার কল আপন হাতে বানান। ওসব কথা আরেক দিন হবে। এই তো পৌঁছে গেছি আমাদের এভারেস্টে, আর ওই– ওই যে– দুটো তালগাছের মাঝখানে বসে আছেন বেগম সাহেবা।
অতদূরে আমাদের সাধারণ কথাবার্তার কণ্ঠস্বর পৌঁছনোর কথা নয়। কিন্তু এই নির্জনতার গভীরতম নৈঃস্তব্ধ্যে বোধ হয় ধ্বনি ও টেলিপ্যাথির মাঝখানে এক তৃতীয় ট্রান্সমিটারহীন বেতারবার্তা বহন করে। শহর-ইয়ার হঠাৎ অকারণে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই আমাদের দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার আলসেশিয়ান মাস্টার তাঁর দিকে ছুট লাগাল।
মাঝপথে দেখা হতেই আমি বললুম, আত্মচিন্তার জন্য এ ভূমি প্রশস্ততম।
বানু বললেন, না, আমি শবৃনমের কথা ভাবছিলুম।
আমি বললুম দেখুন, ম্যাডাম, আপনাদের আনন্দ দেবার জন্যে আমার পক্ষে যা করা সম্ভব আমি তাই করব। ওই তালগাছটা যদি চড়তে বলেন তারও চেষ্টা দিয়ে দেখতে পারি কিন্তু একটি জিনিস করতে আমার সাতিশয় বিতৃষ্ণা। আপনারা দু জনাই আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট; তাই যদি আমি করজোড়ে একটি মেহেরবানি–।
শহর-ইয়ার যদি বটতলার চার আনা দরের সাক্ষীর পেশা কবুল করতেন, তবে তিনি ও-লাইনের সুলতানা রিজিয়া হতেন নিশ্চয়ই। উকিল আধখানা প্রশ্ন শুধোতে না শুধোতেই বটতলার ঘড়েল সাক্ষী আমেজ করে ফেলে, উকিলের নল কোন দিকে নিশানা করেছে। আমাকে বাধা দিয়ে শহর-ইয়ার বললেন, আর বলতে হবে না। ট্রেনে বেশ ধমক দিয়ে বলেছিলেন আপনি নিজের রচনা নিয়ে আলোচনা পছন্দ করেন না, এখানে সেটা ভদ্রভাবে বলতে যাচ্ছিলেন–এই তো? আচ্ছা, আমি মেনে নিচ্ছি, যদিও অতিশয় অনিচ্ছায়। শুধু একটা শেষ প্রশ্ন শুধাব; আপত্তি আছে?
আমি উৎফুল্ল হয়ে বললুম, চালান গাড়ি! ফাঁসির খানা খেয়ে নিন।
শবনমের সঙ্গে সেই শেষ বিরহের পর আপনাদের আবার কখনও দেখা হয়েছিল?
আমি বললুম, এ প্রশ্ন একাধিক পাঠক-পাঠিকা আমাকে বাচনিক, পত্র মারফত শুধিয়েছেন। তাঁর মধ্যে একজন হিন্দু মহিলা; পাবনার মেয়ে স্কুলের হেডমিসট্রেস্। অন্যদের আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিই না। এর বেলা ব্যত্যয় করলুম। লিখলুম, মহাশয়া, আপনি যখন পাবনা সেকেন্ডারি স্কুলের হেড-মিসট্রেস তবে নিশ্চয়ই আপনার স্কুল রাজশাহী ডিভিশনে পড়ে। আমার স্ত্রী সেখানকার স্কুল-ইন্সপেট্রেস। তিনি যখন আবার আপনার স্কুল দেখতে আসবেন, তখন তাঁকে জিগ্যেস করলে পাকা উত্তর পাবেন। আপনাকে ঠিক তা বলছিনে। তবে তারই কাছাকাছি। আমার গৃহিণী বছরে একাধিকবার পুত্রদ্বয়সহ এখানে আসেন। পথিমধ্যে কলকাতায় কয়েক ঘণ্টা জিরোতে হয়। এবার না হয় আপনাদের ওখানেই উঠতে বলব।
শহর-ইয়ারকে সেই ট্রেনে দেখেছিলুম উল্লাসে লম্ফ দিতে, আর দেখলুম এই। সেবারে অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের, এবারে অবিমিশ্রিত উল্লাসের। শুধালেন, কিন্তু তার সঙ্গে আলোচনা করতে পারব তো?
আমি বললুম, কী আশ্চর্য! সেটা আপনাদের দু জনকার একান্ত নিজস্ব, অল রাইটস রিজার্ভড কারবার। সেখানে আমিই-বা কে, আর ডাক্তার জুলফিকারই-বা কে? কী বলেন ডক?
ডাক্তার বললেন, আমার বিবি কী আলোচনা করবেন আর কী করবেন না তার ওপর আমাকে আমাদের ইমাম আবু হানিফা সাহেব কোনও হক দিয়ে থাকলেও খুব সম্ভব তিনি দেননি– আমি কসম খেয়ে বলছি, আমি হক চাইনে– আমি চাই শান্তি।
আমি বললুম, আমেন, আমেন! হায়, এই না-হক্কের ওপর গড়া দুনিয়ার সিকি পরিমাণ স্বামী-সমাজ যদি আমাদের ডাক্তারের এই মহামূল্যবান তত্ত্বকথাটি মেনে নিত তবে বাদবাকি তাঁদের সদৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ডিভোর্স প্রতিষ্ঠানটির উচ্ছেদ সমাপন করত।
ইতোমধ্যে আমরা বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি।
শহর-ইয়ারকে বললুম, একটা কথা আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলুম। আমার কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভালো ভালো রেকর্ড আছে যার বেশিরভাগ না কাম, না অর্থ নাইদার ফর লাভ নর ফর মানি আজ আর পাওয়া যায় না। যখন খুশি বাজাবেন। রাত তিনটেয় বাজালেও আমার আহার-শয্যাসন-ভোজন কোনও কিছুরই ব্যাঘাত হয় না।
শহর-ইয়ার বলল, আমি এখুনি দেখব। হুট করে চলে গেল।
আমি বললুম, ডাক্তার, আপনার বাঙলাতে বিস্তর আরবি-ফারসি শব্দ থাকে। এটা কি আপনাদের পরিবারের বৈশিষ্ট্য, না আপনাদের গোষ্ঠীর, কিংবা আপনারা যে মহল্লায় বাস করেন?
ডাক্তার বললেন, বিশ্বাস করুন, আমি একটি আস্ত অশিক্ষিত প্রাণী। চিকিৎসাশাস্ত্র আমি বলি স্বাস্থ্যশাস্ত্র, তার মানে হাইজিন নয়– আমাকে এমনই মোহাচ্ছন্ন করেছে যে আমি যেটুকু সামান্য সাহিত্য, ইতিহাস এমনকি গণিত স্কুল-কলেজে পড়েছি সেসব ভুলে গিয়েছি। শহর-ইয়ারের সঙ্গে একই জিনিস উপভোগ করার উদ্দেশ্য নিয়ে আমি একাধিকবার চেষ্টা করেছি তার সব শখের বিষয়ে দিল-চসৃপি নিতে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়ে উঠল না। সে এক ট্র্যাজেডি সে কথা পরে হবে। তা সে যাই হোক, মোদ্দা কথা এই, আপনি যে প্রশ্ন শুধিয়েছেন সেটার উত্তর দিতে হলে যেসব বিষয় জানার দরকার তার একটাও আমি জানিনে। তবে যেটুকু শুনেছি তার থেকে বলতে পারি, জব চার্নকের আমলের তো কথাই নেই, এমনকি ক্লাইভের সময় এবং তার পরও কোনও দ্র মুসলমান এবং হিন্দু ও নবাবের মুর্শিদাবাদ, খানদানি-ঢাকা ছেড়ে এই ভুইফোড় আপৃস্টার্ট কলকাতায় আসতে চায়নি। আমার পিতৃপুরুষ আসেন রাজা রামমোহন রায়ের আমলে, বাধ্য হয়ে, কোনও রাজনৈতিক কারণে। তারা আপসে কী ভাষা বলতেন, জানিনে, তবে আমার ঠাকুরদার আমল পর্যন্ত তাঁরা ফারসি ভিন্ন অন্ন কোনও ভাষাতে লেখেননি। আমার পিতা হুতোমের ভাষা বলতে পারতেন, কলকাতার উর্দু ডায়লেট এবং উত্তর ভারতের বিশুদ্ধ দরবারি উর্দুও, কিন্তু আমার মা ছিলেন খাস শান্তিপুরের মেয়ে। তিনি উর্দু জানতেন না এবং সেটা শেখবার চেষ্টাও করেননি। আমাকেও কেউ উর্দু শেখাবার চেষ্টা করেনি। ফলে আমি যে কোন বাঙলা বলি সে আমিও জানিনে। খুব সম্ভব ডাইলিয়ুটেড হুতোম। আমার হিন্দু ক্লাস-ফ্রেন্ডরা আমার ভাষা নিয়ে ঠাট্টা করত। কিন্তু তাদেরই একজন খানদানি কলকাত্তাই সোনার বেনে আমাকে বলেছিল, তার ঠাকুরমা আমারই মতো বাঙলা বলেন।