আল্লার কসম খেয়ে বলছি, জমিল যদি বলত, শহর-ইয়ার আত্মহত্যা করেছে তা হলেও আমি এরকম বুড়ব বনে যেতুম না! শহর-ইয়ার পীর ধরেছে! এ যে বাতুলের বাতুলতার চেয়েও অবিশ্বাস্য। সাধারণতম মুসলমান মেয়েরও নামাজ-রোজার প্রতি যেটুকু টান থাকে সেটুকুকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিলেও যেটুকু থাকার সম্ভাবনা তা-ও তো আমি শহর-ইয়ারের কথাবার্তা চাল-চলনে কখনও দেখিনি। সে নিজেই আমাকে একাধিকবার বলেছে, তার দি তার জান্, তার সব কিছুর এমারৎ দাঁড়িয়ে আছে– চৌষট খাম্বার উপর নয়, রবীন্দ্রনাথের তিন হাজার গানের তিন হাজার স্তম্ভের উপর। সেখানে গুরুবাদই-বা কোথায়, আর পীর সাহেব তো সেই হাজারো স্তম্ভের কোনও একটার পলস্তরা পর্যন্ত নন।
আর এই রমণীর মণি মমতার খনি– সে তো কিছু পাগলা গারদের ইমবেসাইল নয় যে চায়ের কাপে জল ভরে, পেন্সিলের ডগায় সুতো-বঁড়শি লাগিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করবে! শুরু বুঝি তা হলে চায়ের কাপ, আর শহর-ইয়ারের ভক্তি সেই পেন্সিলের বঁড়শি! তাই দিয়ে সে ধরবে ভগবদ্-প্রেম, জাৎ-মোক্ষ!
তা-ও বুঝতুম যদি তার বাউলদের দেহতত্ত্ব গীতে, লালন ফকিরের রহস্যবাদ-মারিফতি জনপদসঙ্গীতের প্রতি মমতা থাকত! এমনকি এই যে রবীন্দ্রনাথের ধর্মসঙ্গীত, বাউল-গান– তার প্রতিও শহর-ইয়ারের বিশেষ কোনও মোহ নেই– সে-কথাও তো সে আমাকে স্পষ্ট বলেছে!
খাটে শুয়ে, বই হাতে নিয়ে পড়ছি, পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছি–তার এক বর্ণও মাথায় ঢুকছে না; ভাবছি শুধু শহর-ইয়ারের কথা, যাকে আল্লাহ মেহেরবানি করে আমার কাছে এনে দিলেন, যে আমার বোনের চেয়েও বোন, প্রিয়ার চেয়েও প্রিয়া!
রাত তখন এগারোটা। শহর-ইয়ার ঘরে ঢুকল।
তাকে কীভাবে দেখব, সে নিয়ে আমার মনে তোলপাড় হচ্ছিল যখন থেকে শুনতে পেয়েছি, সে গুরুলাভ করেছে।
যেমনটি ছিল, তেমনটিই আছে। শুধু পূর্বেকার মতো যখন খাটের পৈথানে এসে খাড়া কাঠের টুকরো ধরে দাঁড়াল তখন স্পষ্ট লক্ষ করলুম, চোখদুটোর উপর যেন অতি হাল্কা স্বচ্ছ দ খানা ফিলমের মতো কীরকম যেন কুয়াশা-কুয়াশার মতো আবরণ। এ জিনিসটে আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। কারণ কুয়াশাভাব থাকা সত্ত্বেও তাতে রয়েছে কেমন যেন একটা বিভ্রান্ত দ্যোতি।
পীর-ভক্ত হওয়ার পূর্বে শহর-ইয়ারের হার্দিক ও দৈহিক সৌন্দর্য একদিনে আমার কাছে স্বপ্রকাশ হয়নি। তার হাসি, তার গান, দূরে থেকে দেখা তার আপন মনে মনে একা একা তালসারির গা ঘেঁষে ভ্রমণ, আমার বাড়ির দেড়তলাতে তার আবাস নির্মাণ, মুসলমান রমণীর স্বাতন্ত্র নিয়ে তার অভিমান– তার আরও কতশত আহারশয্যাসনভোজন, কতকিছুর ভিতর দিয়ে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। দিনে দিনে সে আমার কাছে সুন্দরের চেয়ে সুন্দর, মধুরের চেয়ে মধুর হয়ে বিভাসিত হয়েছে।
আর আজ? আজ থেকে আবার তাকে নতুন করে চিনতে হবে। এ যদি একেবারে নতুন মানুষ হত তবে তো কোনও ভাবনাই ছিল না। নতুন মানুষের সঙ্গে তো আমাদের জীবনভর পরিচয় হয়। কোনও পুরনো মানুষকে আবার নতুন করে চেনা? সামান্য লেখক হিসেবে বলতে পারি :নতুন লেখা তো দু দিন অন্তর-অন্তরই লিখতে হয়, কিন্তু কোনও একটা লেখা যদি হারিয়ে যায় এবং সেইটেই আবার নতুন করে লিখতে হয়, তখন যা যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যেতে হয় সে-তত্ত্বটা শুধোন গিয়ে আমাকে না– খ্যাতনামা লেখকদের।
এর চেয়েও সোজা উদাহরণ দিই। আপনি রইলেন পড়ে দেশে। বন্ধু বিলেত থেকে ফিরলেন পাঁচ বছর পূরে। তার সঙ্গে ফের বন্ধুত্ব জমাতে গিয়ে খাননি মার?
আশ্চর্য! এখনও শুধাল না, আমার কোনও অসুবিধা হয়নি তো, খাওয়া-দাওয়া কীরকম হয়েছে কিছুই না। না, আমি আশ্চর্য হইনি। আমি ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পেরেছি।
আমি স্থির করেছি আমি কোনও ফরিয়াদ করব না– চিঠির উত্তর দিলে না কেন, আপন হাতে প্রত্যেকটি জিনিস বেছে বেছে– বহুত কিছু কলকাতা থেকে সঙ্গে এনে– আমার বাড়ির দেড়তলাতে যে তোমার বাড়ি বানালে সেটা এরকম ছেঁড়া চটিজুতোর মতো না বলে না কয়ে হঠাৎ এরকম উৎখাত করে দিলে কেন; না না, কিছু শুধাব না। আমি ভাবখানা করব, সে হঠাৎ যেন কোনও এতিমখানা বা নাইট স্কুলে এমনই মেতে গিয়েছিল যে আমার তত্ত্বতাবাশ করতে পারেনি। সমস্তটা সহজভাবেই গ্রহণ করব। কিন্তু হায়, সহজ হওয়া কি এতই সহজ? সহজিয়া ধর্মের মূলমন্ত্র সহজ হবি, সহজ হবি–সেটা যদি অতই সহজ হবে তবে বিশ্বসংসারের তাবৎ ধার্মিক-অধার্মিক সর্বধর্ম পরিত্যাগ করে ওই ধর্মই গ্রহণ করল না কেন?
ওদিকে হৃদয় ভরে আসে অভিমানের বেদনায়।
এ রমণীর সঙ্গে যদি আমার সম্পর্ক প্রণয়ের হত তবে তার আজকের অবহেলা আমার হৃদয়ে অন্য প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত। প্রেম তো পূর্ণচন্দ্র। তাই তার চন্দ্রগ্রহণও হয়। কিন্তু বন্ধুত্বও শুক্লপক্ষের চন্দ্রমার মতো রাতে রাতে বাড়ে এবং চতুর্দশীতে এসে থামে। পূর্ণিমাতে পৌঁছয় না। তাই তার গ্রহণ নেই, ক্ষয়ও নেই, কৃষ্ণপক্ষও নেই। তবে আমাদের বন্ধুত্বের ওপর এ কিসের করাল ছায়া!
কিন্তু অতশত চিন্তা করার পূর্বেই প্রাচীন দিনের অভ্যাসমতো মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কী পড়ছ, আজকাল? ওইটেই ছিল আমাদের প্রিয় অবতরণিকা- যা দিয়ে মুখবন্ধ নয়, মুখ খোলা হত।