বললুম, আপনি তো ইমাম গজ্জালির ভক্ত। তার জীবনটাও ভারি অদ্ভুত। তিনি ছিলেন বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাস্থবির যে আমলে কি না, হয়তো এক চীন ছাড়া অন্য কোথাও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের জুড়ি ছিল না– আমি অবশ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদ্যাপীঠের সমন্বয়কে বিশ্ববিদ্যালয় অর্থে ধরছি না। একে তো সর্বজনমান্য রেক্টর, তদুপরি শাস্ত্রীরূপে তিনি মুসলিম জগতে সর্বপ্রখ্যাত। রাজদত্ত অত্যুত্তম পোশাক পরিধান করে যেতেন রাজদরবারেও।
হঠাৎ একদিন তার খেয়াল গেল, এসব তাবৎ কর্ম অর্থহীন বর্বরস্য শক্তিক্ষয়– ভ্যানিটি অব ভ্যানিটিস, অল ইজ ভ্যানিটি, বাইবেলের ভাষায়। সেই রাত্রেই মাত্র একখানা কম্বল নিয়ে বাগদাদ থেকে অন্তর্ধান। পৌঁছলেন গিয়ে সিরিয়ার দমশকশে আশ্রয় নিলেন মসজিদে, ছদ্মনামে। সেই মসজিদের ইমাম ছিলেন উচ্চস্তরের পণ্ডিত। তাঁর সঙ্গে একদিন শাস্ত্রালোচনা হতে হতে সেই পণ্ডিত বললেন, এ আবার আপনি কী বলছেন! স্বয়ং ইমাম গজালির মতো সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত বলেছেন ঠিক তার বিপরীত বাক্যটি!
গজ্জালি ভাবলেন, আর এ স্থলে থাকা নয়। কোনদিন এরা জেনে যাবে আমার প্রকৃত পরিচয়। আর সঙ্গে সঙ্গে লোপ পাবে আমার ধ্যানধারণার সর্ব অবসর।
সেই রাত্রেই অন্তর্ধান করলেন বয়তুল মুকস- জেরুজালেমের দিকে। সেখান থেকে গেলেন ইহুদি, আরব, খ্রিস্টান তিন কুলের পূর্বপুরুষ হজরত ইব্রাহিমের পুণ্য সমাধি দর্শন করে অশেষ পুণ্যলাভার্থে। ভারতবর্ষে হিন্দুরা যেরকম পুণ্যতীর্থে দেবতাকে কোনওকিছু প্রিয় খাদ্য বা অন্য কিছু দান করে, ঠিক সেইরকম ইব্রাহিমের মোকামে মুসলমানরা একটা বা একাধিক শপথ নেয়। ইমাম নিলেন তিনটি। তার মধ্যে সর্বপ্রধান ছিল, এ জীবনে আমি কোনও বিতর্কমূলক বাক্য (কন্ট্রভার্সিয়াল) উত্থাপন করব না।
এখানে এসে আমি চুপ করে গেলুম। স্বেচ্ছায় এবং অতিশয় কূট উদ্দেশ্য নিয়ে।
জয় হোক ভারতীয় রেলের! শতম জীব, সহস্রং জীব– ভারতীয় রেলের কর্মকর্তাগণ।
বোলপুর স্টেশন আমাকে দু খানা ফার্স্ট ক্লাস টিকিট বেচল।
দার্জিলিং মেল পৌঁছল- এই অতি সামান্য নস্যবৎ- দু ঘন্টা লেটে, যাকে বলে বিলম্বিত গাড়িয়াদের একটি হয়ে। তাতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস সব কটা কামরা যে দাজিলিং থেকেই প্রতি আউনস্ ভর্তি, সে খবর না জেনে খুব সম্ভব জেনেই- বোলপুর স্টেশন টিকিট বেচেছে। দার্জিলিঙের কগণ্ডা মেয়ে-স্কুলের ছুটি হয়েছে জানিনে– নীলে নীলে উর্দিপরা মেয়েরা কাঁঠাল-বোঝাই করে ফেলেছে সব কটা কামরা।
সে দুঃস্বপ্ন আজ আর আমার নেই–কী করে কোন কামরায় উঠেছিলম। খুব সম্ভব ক্যাটল ট্রাকে, কিংবা হয়তো এঞ্জিনের ফারনেসে। একদিক দিয়ে ভালোই হল। সে সঙ্কটময় অভিযানে দু জনা দুই কোণে ছিটকে পড়েছি। ডাক্তারের মনটাকে পুনরায় সজীব করার গুরুভার থেকে রেহাই পেলুম বটে, কিন্তু আমার মনটা ক্রমেই নির্জীব হতে লাগল।
দিলবরকে বলেছিলুম কলকাতায় ট্রাঙ্ক-কল করতে। ডাক্তারদের সেই প্রাচীন দিনের গাড়িটা এতদিনে আমার বড় প্যারা হয়ে গিয়েছিল। সে-ও স্টেশনে আসেনি। দুঃখের দিনে নির্জীব প্রাণীও প্রিয়জনকে ত্যাগ করে বলেই কবি হাহাকার করেছেন–
তঙ্গ দস্তিমে কৌ কিসকা সাথ দেতা হৈ।
কি তারিকি ঘেঁ সায়া ভি জুদা হোতা হৈ ইসে।
দুর্দিনে বল, কোথা সে সুজন হেথা তব সাথি হয়?
আঁধার ঘনালে আপন ছায়াটি সেও, হেরো, হয় লয়।
অন্ধকার, অন্ধকার, অন্ধকার। যে পুরো সম্পূর্ণ ফাঁকা উইংটি ঠাকুর্দাদের স্মরণে ডাক্তারের আদেশানুযায়ী চিরন্তন দেয়ালি উৎসব করত সেটিও অন্ধকার। আমি আমার ঘরে গিয়ে ঢুকলুম। স্পষ্ট বোঝা গেল বেয়ারাই সেটা গোছগাছ করেছে। শহর-ইয়ার কোথায়? কে জানে? আমি শুধালুম না। ডাক্তার বললেন, তিনি খাবেন না। ট্রেনের ভিড়ে সন্ধ্যায় নামাজ পড়তে পারেননি। এখন এশার নামাজ পড়ে ঘুমুবেন। কিন্তু শহর-ইয়ার কোথায়, যার পরম পরিতৃপ্তি ছিল স্বহস্তে তার নামাজের ব্যবস্থা করে দেবার?
আমি স্থির করলুম, ডাক্তার যতক্ষণ না নিজের থেকে কথা পাড়ে আমি কিছু শুধাব না।
বিছানায় শুয়ে বই পড়ছি। এমন সময় আমার প্যারা বেয়ারা শহর-ইয়ারেরও –ঘরে ঢুকল। অন্য সময় তার মুখে হাসিই লেগে থাকত, আজ সে যন্ত্রের মতো তার নৈমিত্তিক কর্তব্যগুলো করে যেতে লাগল।
আমি খুব ভালো করেই জানি গৃহস্থের পারিবারিক ব্যাপার কারকুন-কর্মচারী সহচর-সেবকদের শুধাতে নেই, তবু বড় দুঃখে মনে পড়ল শহর-ইয়ার দিলবরজানকে আমার আচার-অভ্যাস সম্বন্ধে একদা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুধিয়েছিল, যাতে করে আমি তাদের কলকাতার বাড়িতে এলে আমার কোনও অসুবিধা না হয়।
তবু দ্বিধাভরা মনে জমিল শেখকে শুধালুম, আমাদের ট্রাঙ্ক-কল সময়মতো পৌঁছয়নি?
জি হ্যাঁ, সে তো সন্ধ্যা সাতটার সময়ই। আমিই ধরেছিলুম।
তবে?
প্রশ্নটার তাৎপর্য ঠিক বুঝেছে। বললে, মাজি বাড়িতে ছিলেন না। তিনি তো দুপুরবেলাই গাড়ি নিয়ে তাঁর পীর সাহেবের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন, আমি
শহর-ইয়ারের পীর! বলে কী! হাবার মতো শুধালুম, পীর!
জমিল ঘাড় ফিরিয়ে যেন অতি অনিচ্ছায় অত্যন্ত আফসোস করে আস্তে আস্তে বললে, সেখানেই তো প্রায় সমস্ত দিন কাটান। তার পর যতদূর সম্ভব আদব-ইনসানিয়ৎ বাঁচিয়ে সালাম হুজুর, গরিবের বেয়াদবি মাফ করবেন বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।