অবশ্য এর সঙ্গে আরেকটি তত্ত্ব যোগ না করলে সম্পূর্ণ সত্য বলা হয় না।
রাধাকৃষ্ণের প্রেম অনেকেই রূপকরূপে গ্রহণ করেন। রাধা মানবাত্মার প্রতীক। কৃষ্ণ পরমাত্মার। কৃষ্ণমিলনের জন্য রাধার হাহাকার আর পরমাত্মার কামনায় মানবাত্মার হাহাকার একই ক্রন্দন।
সুফিদের ভিতরে ওই জিনিসটি আছে। আপনি পাঁচজন মৌলানাকে জিগ্যেস করলে তার অন্তত চারজন বলবেন, হাফিজ যেখানে মদ্যপানের উল্লেখ করছেন সে মদ্য মদ্য নয়। সে মদ্য আল্লার প্রতি মহব্বত- ভগবদ্প্রেম। যে সাকি মদ্য বিতরণ করেন তিনি মুর্শিদ অর্থাৎ শুরু। তিনি শিষ্যকে মদ্যপানে আসক্ত করান গুঢ়ার্থে আল্লার প্রেমে অচৈতন্য হতে, সেই চরম সত্তা পরমাত্মায় আপনা সত্তা সম্পূর্ণ বিলীন করে দিতে শিক্ষা দেন।
পার্থিব প্রেমকে আধ্যাত্মিক প্রেমের স্তরে নিয়ে যাবার জন্য খ্রিস্টান এবং ইহুদি মিস্টিক– রহস্যবাদী– ভক্তও ওই প্রতাঁকের শরণাপন্ন হন।
কিন্তু আপনি-আমি– আমরা সাধারণ মানুষ। আমরা কাব্য পড়ি কাব্য-রসের জন্য আর কোনওদিন যদি আপনার ধর্মানুরাগ নিবিড়তর হয় তবে আপনার ভাবনা কী? আপনার ঘরেই তো দেখলুম ইমাম গজ্জালির সৌভাগ্য স্পর্শমণি বাঙলা অনুবাদে।
.
১২.
পরিপূর্ণ সুখশান্তির উপর অকস্মাৎ কীভাবে বজ্রপাত হয়– এই আমার বিকটতম অভিজ্ঞতা।
ইতোমধ্যে আমি অভিমন্যুকে হার মানিয়ে, শহর-ইয়ার ও ডাক্তার নির্মিত চক্রব্যুহ ভেদ করে মোকামে ফিরে এসেছি।
আবার সেই খাড়াবড়ি-উচ্ছেতে যখন অধরোষ্ঠ পরিপূর্ণ বিতিক্ত তখন হঠাৎ একদিন লক্ষ করলুম, ডাক্তার পরিবার আমাকে যেন কটু করেছে। আমি পরপর দু খানা চিঠি লিখলুম, শহর-ইয়ারকে। কোনও উত্তর পেলুম না। এ যে নিদারুণ অবিশ্বাস্য! তখন লিখলুম ডাক্তারকে। অবিশ্বাসের তারতম্য হয়? হয়। এ যেন আরও অবিশ্বাস্য! এ যেন সেই প্রাচীন যুগের টেলিফোনে নো রিপ্লাই মিস?
আমি কী হীন, নীচ! যাক গে চুলোয়। বলে যেই বারান্দায় বেরিয়েছি, দেখি, দূর থেকে মাঠ ঠেঙিয়ে আসছে ডাক্তার। আর তাকে অভ্যর্থনা জানাতে ছুটে যাচ্ছে আমার আলসেশিয়ান মাস্টার তার রিজার্ভ স্পিডও ছেড়ে দিয়ে।
আমি বারান্দা ছেড়ে যেই রোদ্দুরে নামতে যাচ্ছি এমন সময় লক্ষ করলুম, দূর থেকে ডাক্তার হাত নেড়ে বোঝাবার চেষ্টা করছে, আমি যেন অযথা এই কড়া রোদ্দুরে না নামি।
ডাক্তার পৌঁছল। লগেজ দূরের কথা, হাতে একটি এটাচি পর্যন্ত নেই।
এ বাড়ির কর্তা দিলবরজান–কুকুশে-মেজরডমো– দুই মিনিটের ভিতর বালতি করে জল সাবান গামছা ধুদুল ডাক্তারের পায়ের কাছে রাখল। ডাক্তার তার আপনজন। মনে নেই, কখন কোন বারে সে দিলবরের কোন এক মাসিকে বাঁচিয়ে দ্যায়!
ডাক্তারের চুল উস্কোখুস্কো। হাতদুটো অল্প অল্প কাঁপছে। কপালে ঘামের ফোঁটা।
শুধু দেহের দিক দিয়ে, এ ধরনের অপ্রমত্ত, শান্তসমাহিতচিত্ত লোকও যে রাতারাতি হঠাৎ মৃগী রুগীর মতো চেহারা ধারণ করতে পারে, এ যেন সুফি-সাধুর অকস্মাৎ মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা পেয়ে নীরব আর্তনাদ!
আমি এমনই হতবুদ্ধি হয়ে গেলুম যে তাকে কুশল প্রশ্নও শুধোতে পারলুম না। কিংবা হয়তো আমার মগ্নচৈতন্য তার অতল থেকে কোনওপ্রকারে প্রতিক্রিয়া আমার চৈতন্যলোকে পাঠাতে সম্মত হল না। আর কুশল প্রশ্ন শুধোবই-বা কী? যা দেখছি সে তো জড়ভরতও লক্ষ করত। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম।
আল্লা যেন হঠাৎ আমাকে আদেশ দিলেন। দিলবরজানকে বললুম, এখানে না। ওঁকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে চান করিয়ে, তাজা জামাকাপড় পরিয়ে নিয়ে আয়।
যে ডাক্তার কারও কোনওপ্রকারের সাহায্য নিতে সদাই কুণ্ঠিত, বিব্রত বিদ্রোহী পর্যন্ত বলা চলে– সেই ডাক্তার কলের পুতুলের মতো দিলবরের পিছনে পিছনে চলে গেল।
আমি বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে শুধালুম-কী করে শুধালুম জানিনে–শ-ইয়ার?
যেন পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে উত্তর এল, ভালো আছে। না, ভুল বললুম। শুধু ঘাড় নাড়িয়ে ওই সংবাদটুকু দিল।
তা হলে কী হয়েছে?
এর পর তাকে খাওয়াবার চেষ্টা, শোওয়াবার চেষ্টা, কথা বলার চেষ্টা– এসব নিষ্ফল প্রচেষ্টার পীড়াদায়ক বর্ণনা দিয়ে কে কাকে পীড়া দিতে চায়!
কোথা থেকে মানুষ কখন কী অনুপ্রেরণা পায় কে জানে? দিলবরকে বললুম, যাও, রিকশা নিয়ে এসো। আমরা কলকাতা যাচ্ছি। আর ডাক্তারের কোট-পাতলুন আমার সুটকেসেই ভরে দাও। এ লোকটাকে আবার কাপড় ছাড়ানো– সে তো হবে আলট্রামডার্ন সোসাইটি লেডির রুগ্ণ বাচ্চাকে সায়েবি কায়দায় বেকার পাঁচবার কাপড় বদলানো।
আমি অন্ধভাবে বুঝতে পেরেছি, এখানে ডাক্তারকে আটকে রেখে কোনও লাভ নেই। যা হবার হবে কলকাতায়। ডাক্তারের জীবন বলতে বোঝায় তার দুটি শ্বাস-প্রশ্বাস তার শহর-ইয়ার আর তার রিসার্চ এবং যেহেতু শহর-ইয়ারকে সঙ্গে নিয়ে আসেনি অতএব নিশ্চয় সে-ই। আর যে ডাক্তার ঘাড় নেড়ে জানাল সে ঠিক আছে–ও, না, সে তো আমার অনুমান।
সঙ্গে নিলুম গজ্জালির কিমিয়া আর হুজবেরির কশফ-অল-মহজুব।
রিকশাতে উঠে ইচ্ছে করেই আরম্ভ করলুম, বকর-বকর। কিন্তু সেটা মোটেই সহজ কর্ম হয়নি। আর সহজ-কঠিন যাই হক, ফল হল সম্পূর্ণ বেকার। এ যেন ধুয়োর সঙ্গে কুয়াশার লড়াই। এমনকি তাতে করে ধুয়াশাও তৈরি হল না।
ডাক্তার আচারনিষ্ঠ মুসলিম। তাই আরম্ভ করলুম ধর্মতত্ত্ব নিয়ে যেন কিছুটা আত্মচিন্তা কিছুটা বক্তৃতা। একটা বিশেষ মতলব নিয়ে।