আমি বললুম, গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে সেই কবে যে আমার যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গিয়েছে সেটা স্মরণেই আসছে না। এদিকে আবার কলকাতা আর রাঢ়ের মুসলমানদের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়নি। তাই জানতে ইচ্ছা করে, আপনাদের ভিতরও মেয়ের জন্য বর যোগাড় করা কি একটা সামাজিক সমস্যা হয়ে উঠেছে?
আমাদের আত্মীয়স্বজন তো নেই বললেই হয়; তবু যেটুকু খবর কানে আসে তার থেকে মনে হয়, কলকাতার মুসলমান সমাজের প্যাটার্ন ক্রমেই হিন্দু প্যাটার্নের কাছাকাছি এসে যাচ্ছে। আর্থাৎ মুসলমান যুবকও চায়, তার স্ত্রী যেন শিক্ষিতা হয়, গানটান জানলে তো আরও ভালো, এবং সে নিজে যদি লেখাপড়ার নাম করে থাকে তবে হয়তো মনে মনে এ আশাও পোষণ করে যে শ্বশুর তাকে বিলেত পাঠাবে। তবে যতদূর জানি, এদের খাইগুলো এখনও রূঢ় কর্কশরূপে সমাজে প্রকাশ করা হয় না।
আমি বললুম, সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে হিন্দু সমাজও তার প্যাটার্ন বদলে বদলে আমাদের কাছে চলে আসছে। আমার ছেলেবেলায় হিন্দুর পণপ্রথা যতখানি নির্দয় ছিল আজ তো নিশ্চয়ই ততখানি নয়। আর লভ ম্যারেজের সংখ্যা যতই বাড়বে, পণপ্রথা ততই বাতিল হতে থাকবে।
শহর-ইয়ার বললে, আমার কিন্তু ভারি কৌতূহল হয়, এই যে হিন্দুরা ডিভোর্স, মনোগেমি, বাপের সম্পত্তিতে মেয়ের অধিকার এসব আইন চালু করল তার ফল আখেরে হিন্দু সমাজকে কীভাবে পরিবর্তন করবে?
গ্রামাঞ্চলে কিছুই হবে না। মনোগেমি ছাড়া আর দুটো আইন তো মুসলমানদের ছিলই। তবু আমাদের সমাজে ডিভোর্স হত কটা? বাপের সম্পত্তির হিস্যে নিয়ে কটা মেয়ে ভাইদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা লড়েছে। আর মনোগেমি আইন না থাকা সত্ত্বেও বাঙলা দেশের কটা মুসলমান ভদ্রলোক দুটো বউ পুষেছে। হিন্দুদের বিধবা-বিবাহ আইনসম্মত হয়েছে প্রায় একশো বছর আগে। দ্র হিন্দু সমাজে তার ফলে প্রতি বৎসর কটা বিধবা-বিবাহ হয়? না, দিদি, এদেশের অদৃশ্য, অলিখিত আইন–মেয়েরা যেন মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে। তা সে মুসলমানই হোক, আর হিন্দুই হোক।
শহর-ইয়ার অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, বোধ হয় আপনার কথাই ঠিক।
আমি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলুম, কিন্তু যা বললুম, তার সঙ্গে আমার আরেকটা কথা যোগ না দিলে আমার বক্তব্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সেটা সোজা বাঙলায় এই, বলি তো অনেক কথা, কিন্তু যখনই চিন্তা করি তখনই দেখি, আমাদের সমাজ যে কোন দিকে চলেছে তার কোনওকিছুই অনুমান করতে পারছি না।
শহর-ইয়ার আমার সর্বশেষ মন্তব্যটি বোধ হয় শুনতে পায়নি; দেখি দৃষ্টি যেন দেয়ালের ভিতর দিয়ে দূর-দূরান্তর চলে গিয়েছে। হঠাৎ বললে, এদেশের মেয়েরা আপন পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে সামান্যতম প্রতিবাদ জানাবে কী করে? তার জন্য তো আপনার ওই শ্রীরাধাই দায়ী। বৈষ্ণব কবিরাই তো তাঁকে শত শত গানে সহিষ্ণুতার সাক্ষাৎ মূর্তিমতী প্রতিমারূপে নির্মাণ করে তুলেছেন। কৃষ্ণ তার প্রতি যে অবিচার করে চলে গেলেন তাই নিয়ে তাঁর রোদনক্রন্দন হাহাকার আছে শত শত গানে, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা বিদ্রোহ, অভিসম্পাত না-হয় বাদই দিলুম, আছে কি কোনওখানে উল্টো তিনি তো বসে রইলেন গালে হাত দিয়ে ঠাকুরের প্রতীক্ষায়। যদি তিনি কোনওদিন ফিরে আসেন! এই শ্রীরাধাই তো হলেন আমাদের হিন্দু প্রতিবেশিনীর আদর্শ।
শহর-ইয়ার গরম। অবশ্য মাত্রাধিক নয়।
আমি বললুম, সুন্দরী, আপনি এখন যা বললেন তার উত্তরে আমাকে একখানা পূর্ণাঙ্গ থিসিস ঝাড়তে হয়। অতিশয় সংক্ষেপে উত্তর দিই।
ইসলাম অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে আরবদের অন্ধকার যুগে– জাহিলিয়ায়– অতি উচ্চাঙ্গের কাব্য রচিত হয়েছিল। বলা বাহুল্য, সে কাব্যে ইসলামের একেশ্বরবাদ তো নেই, যা আছে সে-সব জিনিস কেউ বিশ্বাস করলে তাকে আর মুসলমান বলে গণ্য করা যাবে না, অথচ এসব কাব্য পড়েন শিক্ষিত আরব মাত্রই তা সে তিনি ধার্মিক মৌলানাই হোন, আর সাদামাটা কাব্য-রসিক হোন– কিন্তু বিশুদ্ধ কাব্যরূপে, অতি অবশ্যই তার থেকে ধর্মানুপ্রেরণা পাবার জন্য নয়। তাই আমার তাজ্জব লাগে, যখন এদেশের গোড়ারা আপত্তি তোলেন কোনও মুসলমান বালক বাঙলা সাহিত্যের গভীরে প্রবেশ করার জন্য রামায়ণ-মহাভারত, পদাবলী, মঙ্গলকাব্য পড়লে। মধ্যযুগের একাধিক মুসলিম কবি বাণী-বন্দনা দিয়ে তাঁদের কাব্য রচনার গোড়াপত্তন করেছেন। অথচ কাব্যের গভীরে প্রবেশ করলেই দেখা যায়, এঁদের প্রায় সকলের উদ্দেশ্য ছিল, ইসলামের মূল সরল নীতি বাঙলার মাধ্যমে প্রচার করা। আরেকটা উদাহরণ নিন। পরধর্ম বাবদে খ্রিস্টান মিশনারিরা যে অত্যধিক সহিষ্ণু একথা তাঁদের পরম শত্রুরাও বলবে না। অথচ এদের অধিকাংশই গ্রিক শেখার সময় ওই ভাষাটি না শিখে নিউ টেস্টামেন্ট মূলে পড়ার উপায় নেই বিস্তর দেবদেবীতে ভর্তি প্রাক-খ্রিস্ট গ্রিকসাহিত্য গভীরতম শ্রদ্ধার সঙ্গে পড়েন। হাতের কাছের আর একটা উদাহরণ নিন। ইরানে ইসলাম আগমনের পূর্বে যেসব রাজা, বীর, প্রেমিক-প্রেমিকার কাহিনী লোকমুখে প্রচলিত ছিল, সেগুলো নিয়ে মুসলমান ফিরদৌসি লিখলেন তাঁর মহাকাব্য শাহনামা –সে কাব্য পড়েন না কোন মৌলানা?
আপনি হয়তো বলবেন, পদাবলী সাহিত্য বৈষ্ণব ধর্মের অঙ্গবিশেষ; অতএব সে সাহিত্য থেকে হিন্দু তার জীবনাদর্শ গ্রহণ করেন। উত্তম প্রস্তাব। আপনি ভাবছেন বাঙলার হিন্দু রমণী শ্রীরাধার কাছ থেকে তার সহিষ্ণুতা শিখেছে। কিন্তু কই, সে তো তারই অনুকরণে আপন স্বামী ত্যাগ করে অন্য পুরুষে হৃদয় দান করে না। এদেশের কোনও মেয়েরই প্রশংসা করতে হলে আমরা সর্বপ্রথমই বলি, আহা, কী সতীলক্ষ্মী মেয়েটি!