কিন্তু বাদবাকি দুনিয়াটা তো আর বেখেয়াল নয়। একটি এম.এ. ক্লাসের ছেলে তাকে লক্ষ করছিল বছর দুই ধরে। কারণ ভাগ্নিটি যে-বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে গান শিখত ছেলেটি থাকে তার সামনের বাড়িতেই। প্রথমে মুগ্ধ হয়েছিল ভাগ্নির মিষ্টি গলাটি শুনে, তার পর সামান্য অনুসন্ধান করে তার সম্বন্ধে বাদবাকি খবর যোগাড় করল। বিবেচনা করি ছোকরা আকাশ-ছোঁয়া লক্ষ মেরেছিল যখন জানতে পারল মেয়েটি তারই মত মুসলমান। ইতোমধ্যে সে আবার এম. এ. পাস করে কোন একটা কলেজের লেকচারার হয়ে গিয়েছে। তাকে তখন ঠেকায় কে?
ভাগ্নির নামঠিকানা, তার সম্বন্ধে যাবতীয় বৃত্তান্ত তার চাচাতো ভাবীকে বয়ান করে বললে, বিয়ের প্রস্তাব পাঠাও- অবশ্য সোজাসুজি না, কনেপক্ষের এক দূর আত্মীয়ের কাছে। আলাপচারী বেশ খানিকটে এগিয়ে যাওয়ার পর স্থির হল, অমুক দিন বরপক্ষ থেকে অমুক অমুক মুরুব্বি মহ ইত্যাদি স্থির করবার জন্য আমাদের বাড়িতে আসবেন। ইতোমধ্যে অবশ্য ভাগ্নির চাচা খবর নিয়ে জেনেছেন ছেলেটি সত্যই অত্যুত্তম দুলহার পর্যায়ে পড়ে।
আমাদের এখানে এসে আলোচনা করার আগের দিন সেই দুই ভদ্রলোক যাদের সঙ্গে পরে আপনি কথাবার্তা কইলেন– দুলহার বাপ-মা এবং অতিশয় অন্তরঙ্গ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বসে আলোচনা করে জেনে নিলেন, মহর, গয়নাগাঁটি, ফালতো শর্ত যদি আমরা চাই ইত্যাদি তাবৎ আইটেমে তারা কতখানি মেকসিমামে উঠতে পারেন। এবং আকছারই এসব ক্ষেত্রে যা হয় তার ব্যত্যয়ও হল না। রাত দুটো না তিনটে অবধি দফে দফে আলোচনা করার সময় বিস্তর মতভেদ, প্রচুর তর্কাতর্কি ততোধিক মনোমালিন্য হল। দুলহার চাচার অনেকগুলি ছেলে। তার বক্তব্য এবং সে বক্তব্য অতিশয় যুক্তিসঙ্গত যে, তোমরা যদি আজ দরাজদিলে, মুক্তহস্তে বরপক্ষের দাবিদাওয়া মেনে নাও তবে আমার ছেলেগুলোর বিয়েতেও দুহিন পক্ষ এই বিয়ের নজির দেখিয়ে এরই অনুপাতে দাবি করে বসবে প্রচণ্ড মহর অষ্ট-অলঙ্কারের বদলে অষ্টগণ্ডা এবং খুদায় মালুম আর কী কী। অতএব সর্বাবদে ম্যাসিমামটা আরও নিচে নামাও, কলকাতায় দুলহিনের অভাব নেই, তারই পরিচিতদের ভিতরে এন্তার ডানা-কাটা হুরীপরী রয়েছে।
সবাই তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, তাঁর ভয় সম্পূর্ণ অমূলক। অর্থনৈতিক চাপেই হোক বা সামাজিক যে কোনও কারণেই হোক, এখন মুসলমান মেয়ের অবস্থা প্রায় হিন্দু মেয়েরই মতো। তাদেরই মতো এখন বরপক্ষই জোরদার পক্ষ। দুহার চাচা তার এতগুলো ছেলে নিয়ে তো রীতিমতো ম্যারেজ-মার্কেট কর্নার করবেন এবং ওই ধরনের আরও কত কী।
তা সে যা-ই হোক, রাত প্রায় দুটো না তিনটের সময় রফারফি হয়ে দফে দফে ম্যাকসিমামগুলো পিন্ ডাউন করা হল।
এ সভাতে দুলহার থাকার কথা নয়। সে ছিলও না। কিন্তু সামনের ঘরে তার চাচাতো ভাবীর সঙ্গে বসে আলোচনার প্রত্যেকটি শব্দ বুঝতে তার কোনও অসুবিধা হয়নি। সে গুম হয়ে বসে রইল।
পরদিন অতি ভোরে ভাবীর মারফত সে তার আব্বাকে খবর পাঠাল, দুলহিন পক্ষের সব দাবিদাওয়া যেন তাদের চাহিদামাফিক মেনে নেওয়া হয়। দুলহা পক্ষের দর-কষাকষির দরুন যদি শাদি ভেস্তে যায় তবে সে স্কলারশিপ নিয়ে নাকবরাবর বিলেত চলে যাবে এবং কস্মিনকালেও এদেশে ফিরবে না। পক্ষান্তরে শাদি যদি হয়ে যায় তবে সে চাচাতো ভাইদের পরিবারের পছন্দমতো জায়গায় তাদের শাদির জিম্মাদারি এইবেলাই আপন স্কন্ধে নিচ্ছে।
প্রথমটায় তো লেগে গেল হৈ হৈ রৈ রৈ। কিন্তু বাপ-মা জানতেন, ছেলেটা ভয়ঙ্কর একগুয়ে এবং চাচাও জানতেন তার কথার নড়চড় হয় না। ভাইদের বিয়ে সম্বন্ধে যে প্রতিজ্ঞা করেছে সেটা রাখবেই। অতএব শেষটায় সেই দুই ভদ্রলোককে সর্ববাবদে আকাশে-ছোঁয়া ম্যাকসিমামের সর্ব এখতেয়ার দেওয়া হল।
অবশ্য আপনার কেরানি কিছু কম নয়।
আমি চটে গিয়ে বললুম, ব্যস, ব্যস্ হয়েছে।
শহর-ইয়ার আমার কপালে হাত বুলোতে বুলোতে বললে, আহা! আপনি কেন বিরক্ত হচ্ছেন? আপনি না থাকলে আপনার ডাক্তার সাহস করে পাঁচ হাজারেরও ময়ূর চাইতে পারতেন না। আর বরপক্ষ যে সুবোধ বালকদ্বয়ের ন্যায় আপনার সব তলব মেনে নেবে, এ তত্ত্বটা না জেনেই তো আপনি কনের জন্য বেস্ট টার্মস গুছিয়ে নিলেন। আচ্ছা, আমি কী বলি আর কী কই সে আপনি বাদ দিয়ে শুধু এইটুকু শুনে রাখুন ডাক্তারের ভাগ্নিবাড়িতে আপনার খ্যাতি রটেছে যে আপনি এমনই ত্রিকালজ্ঞ পীরসাহেব যে বরপক্ষের ওপর এক ঝলক চোখ বোলাতে না বোলাতেই সাফসুতরো অতিশয় পরিপাটিরূপে মালুম করে নিয়েছিলেন যে ওঁরা আপনার তলব মাত্র আপনার খেদমতে পেশ করার জন্য সঙ্গে ফ্লাস্কে করে বাঘের দুধ নিয়ে এসেছিল।
বললুম, আপ্যায়িত হলুম এবং আজ সন্ধের গাড়িতেই আমি বোলপুর চললুম।
শহর-ইয়ার সেদিকে খেয়াল না দিয়ে বললে, কিন্তু আসল কথাটা যে এখনও বলা হয়নি। আমি কোন কথা দিয়ে আমার বয়ান আরম্ভ করেছিলুম মনে আছে? মুসলমান মেয়ে অন্দরমহল ত্যাগ করলে তার সুবিধে-অসুবিধের কথা। এইবারে দেখুন, ডাক্তার সাহেবের ভাগ্নি যদি জনানা ত্যাগ করে কলেজ যাওয়া আরম্ভ না করত তবে কি এরকম একটি উৎকৃষ্ট বরের নজরে পড়ত, এবং এরকম সসম্মানে তার বিয়ের ব্যবস্থা হতে পারত? ও যদি ম্যাট্রিকের পর চাচার সঙ্গে ফসাদ করে না বেরিয়ে পড়ে অন্দরমহলে বসে বসে দিন কাটাত তবে কি তার চাচা মাথা খুঁড়েও এরকম একটি বর জোটাতে পারতেন?