কিন্তু হায়, নল রাজার ভাজা মাছটির মতো আমার মুগ্ম-মুসল্লমগুলো হঠাৎ পাখনা গজিয়ে ডানা মেলে কোক্কোরো রব ছেড়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ট্রেনে কথা ছিল, যেখানেই উঠি না কেন, ডাক্তার-পরিবার প্রথম একটা ডিনার দিয়ে মুখবন্ধ অবতরণিকা সেরে পরের পরিপাটি ব্যবস্থা করা হবে, কিন্তু বন্ধুর বাড়িতে উঠেই দেখি আমার নামে টেলিগ্রাম– তদ্দশ্যেই শান্তিনিকেতন ফিরে যেতে হবে।
সে রাত্রেই আপার-ইন্ডিয়া ধরতে হল। রেলের মোন্দার ঠেলেঠুলে একটা কামরায় ঢুকিয়ে দিল।
ঘন্টু বাগচীকে বরাত দিয়ে এলুম সে যেন আমার আকস্মিক নির্ঘণ্ট পরিবর্তনটা শহর-ইয়ার বানুকে জানিয়ে দেয়। আমার রাঢ়ী, বৈদিক, কুলীন, মৌলিক মেলা চেলা আছে, কিন্তু মুসলমানকে ট্যা করতে হলে বারেন্দ্রই প্রশস্ততম। ওরা এখনও বদনা ব্যবহার করে।
বোলপুরে ফিরে হপ্তা তিনেক সাধনার ফলে মুরগি রোস্টের শোক ভুলে গিয়ে যখন পুনরায় ঝিঙ্গে-পোস্ত, কলাইয়ের ডাল আর টমাটোর টকে মনোনিবেশ করছি এমন সময় শুনি তীব্র মধুর বামা-কণ্ঠ। আমার বাড়িটা এক্কেবারে শুশানের গা ঘেঁষে, অর্থাৎ লোকালয় থেকে দূরে নির্জনে। বামা-কণ্ঠ কেন, কোনও কণ্ঠই সেখানে শোনা যায় না। বারান্দায় বেরিয়েই দেখি, শহর-ইয়ার, দূরে ডাক্তার, তারও দূরে প্রাচীন যুগের ইয়া লাশ মোটরগাড়ি।
আমার মুখ দিয়ে কথা ফোটেনি। শহর-ইয়ার পুরো-পাক্কা বাঙালি-মুসলমানি কায়দায় মাটিতে বসে, মাথায় ঘোমটা টেনে, দু হাত দিয়ে আমার দু পা ছুঁয়ে সালাম করল। আমি তাকে দোয়া জানালুম, মনে মনে দরুদ পড়লুম।
এবারে দেখি ওর ভিন্ন রূপ। আমি আশঙ্কা করেছিলুম সে কলরব করে নানান অভিযোগ আরম্ভ করবে– খবর না দিয়ে চলে এলুম, এসে একটা চিঠি-পত্র দিলুম না– বাকি আর বলতে হবে না; মেয়েরা ফরিয়াদ আরম্ভ করলে যাদুকরের মতো ফাঁকা বাতাস থেকে ফরিয়াদের খরগোশ বের করতে পারে।
শুধু অত্যন্ত নরম গলায় বলল, আমরা কোনওপ্রকারের খবর না দিয়ে এসে আপনাকে কোনও বিপদে ফেলিনি তো?
আমি বললুম, আমি সত্যই ভারি খুশি হয়েছি যে আপনারা আমাকে আপনজন ভেবে কোনওপ্রকারের লৌকিকতা না করে সোজা এখানে চলে এসেছেন বলে।
ইতোমধ্যে ডাক্তার এসে পৌঁছেছেন। তার সঙ্গে কোলাকুলি করে তাকেও সেই কথা বললুম এবং যোগ করলুম, আপনারা জানেন না, এদেশে আমার খুব বেশি আপনজন নেই।
শহর-ইয়ারের চোখ দুটি বোধ হয় সামান্য একটু ছলছল করছিল। বলল, আমাদেরও বেশিরভাগ আপনজন পাকিস্তান চলে গিয়েছেন। আমার দাদারা, দিদিরা সবাই। সেদিক দিয়ে আমার কর্তা লাকি।
আমি কিছু বলার পূর্বেই ডাক্তার প্রায় হাতজোড় করে বললেন, আমার একটা গরিবানা আর আছে।
আমি বললুম, কী উৎপাত। আমাকে চিনতে আপনার শতাব্দী লাগবে?
তা হলে বলি; আপনার চেলা ঘন্টুবাবু এসেছিলেন আপনার চলে যাওয়ার খবর দিতে। উনি সত্যি আপনার আপনজন। তাঁকে ইনি নানা রকমের প্রশ্ন শুধোন– এ জায়গা সম্বন্ধে। ঘন্টুবাবু বললেন, আপনি নাকি বাজার-হাট থেকে অনেক দূরে থাকেন, এবং চাকর-বাকর কামাই দিলে নাকি শুধু টিন-ফুড খেয়ে চালিয়ে দেন। তাই আমরা এটা-সেটা কিছু কিছু সঙ্গে এনেছি। যদি
আমি বললুম, কী আশ্চর্য! নদীতে চানে যাবার সময় কলসি ভরে জল নিয়ে যাওয়া আহামুকি কিন্তু আমার এই সাহারা-নিবাসে জল না নিয়ে আসা ততোধিক আহাম্মুকি। আপনি সমুচা হবাজার কিনে এনে থাকলেও অন্তত আমার কোনও আপত্তি নেই। চলুন, আপনাদের ঘর দেখিয়ে দিই; হাত-মুখ ধোবেন।
আমার লোকটি খুব মন্দ রাধে না। সে-বিষয়ে আমার অত্যধিক দুশ্চিন্তা ছিল না।
বারান্দায় বসে আছি। হঠাৎ দেখি শহর-ইয়ার তালগাছ সারির গা ঘেঁষে ঘেষে একা একা চলেছেন রেললাইনের দিকে। আমি বসার ঘরে ঢুকলুম ডাক্তারের খবর নিতে। তিনি দেখি আমার জর্মন এনসাইক্লোপিডিয়া খুলে একটার পর একটা ছবি দেখে যাচ্ছেন– আরামসে বড় কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে। আমি যেতেই বললেন, শহর-ইয়ার বেড়াতে বেরিয়েছে; ও একা থাকতে ভালোবাসে আবার, মজার কথা, খানিকক্ষণ পরে সঙ্গী না হলেও চলে না। এই দেখুন না, একশো কুড়ি মাইল ঠেঙিয়ে এল এখানে আপনার সঙ্গে দেখা করতে, আর আপনার সঙ্গে দুটি কথা না বলে হুট করে বেড়াতে চলে গেল একা একা।
তা আপনি সঙ্গে গেলেন না কেন?
ওর মুড আমি জানি। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলে বেঁধে নিয়ে যেত– আমি শত আপত্তি জানালেও। বেড়াক না একটু আপন মনে। আপনার বাড়ির বড় সুবিধে সিঁড়ি দিয়ে নামামাত্রই বেড়াবার মাঠ আরম্ভ হয়ে গেল! কলকাতার হাল তো জানেন। তার পর একটু থেমে গিয়ে বললেন, কিন্তু আপনার কাছে অনুরোধ, আপনার ডেলি রুটিন আমাদের আসাতে যেন আপসেট না হয়।
আমি হেসে বললুম, আপনি নির্ভয়ে থাকুন, ডাক্তার, আমার রুটিন বলে কিছু নেই। আমি শুধু বলি, এনজয় ইয়োরসেলভস। আচ্ছা, এখন চলুন না, আমরা ম্যাডামকে খোয়াইডাঙার মাঝখানে গিয়ে আবিষ্কার করে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসি। এখানে এই বিরাট খোলামেলার মাঝখানে যে কীরকম টপ করে অন্ধকারটি ড্রপ করেন সেটা শহুরেরা অনুমানও করতে পারে না।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে বললুম, ওই ওখানে যে গোটা দুই ভিতের মতো ঢিপি দেখতে পাচ্ছেন, ওইটেই এ অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। সেখানে উঠলেই ঠাহর হয়ে যাবে বিবি কোথায় কবিত্ব করছেন।