আবার কান পেতে শুনলুম, বলছেন, অতি বিশ্বস্ত আমাদেরই প্রাচীন নায়েব বংশের ছেলে এখন নায়েব আছেন, কর্মচারীরাও বিশ্বস্ত, তবু আমার জান পানি পানি। নায়েবকে আমি সর্ব ডিসিশন নেবার ভার কমপক্ষে সাতান্নবার বলেছি, বিরক্ত হয়ে কাগজ লিখে ডাকে তার বাড়িতে পাঠিয়েছি। কোনও ফল হয়নি। সে কাজ করে যায় তার আব্বার কাছ থেকে ঐতিহ্যগত যে পদ্ধতিতে কাজ শিখেছে। দু দিন অন্তর অন্তর এ বাড়িতে এসে সভয় নয়নে উঁকিঝুঁকি মারে– হুজুরকে কখন বিরক্ত না করে দুটো ডিসিশন ফাইনেলাইজ করে নেওয়া যায়। এই উঁকিঝুঁকিটা আমাকে বিরক্ত করে আরও বেশি। আমি কি বাঘ, তাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলব! যদ্দিন তার বাপ বেঁচেছিলেন, আমি ছিলুম সুখে। সপ্তাহে একদিন এসে দশ মিনিট ধরে গড়গড় করে যা কিছু করেছেন সেগুলো বলে নিয়ে শুধোতেন, ঠিক আছে তো, মিয়া? অনেকটা আমার সেই ঠাকুন্দার রিপোর্ট দেওয়ার মতো। অবশ্য প্রায় দুটি বচ্ছর সর্ব আপত্তি, প্রতিবাদ, চিৎকার সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, বলতে গেলে প্রায় আমার কানে ধরে সব কটা বাড়ি বার বার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিয়েছেন, সব কাজ শিখিয়েছেন। ওইসব বাড়ি আর তাদের ভাড়াটে আমার জন্য দুনিয়ার দোজখরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন।
এখন যদি একতলা আর তিনতলাটা ভাড়া দিই তবে সেটা খাল কেটে ঘরে কুমির আনা নয়, সেটা হবে ক্লাইভ এনে ব্রিটিশ রাজত্ব স্থাপন করা। সিরাজ-উদদৌলার মতো আমার মুণ্ডটি যাওয়াও বিচিত্র নয়।
অন্য কোনও ব্যবস্থার কথা যে একেবারেই ভাবিনি তা নয়, কিন্তু আমার সময় কোথায়?
.
১১.
আল্লাতালা যাকে খুশি তোলেন, যাকে খুশি নামান– এ সত্যটি পাপীতাপী আমরা প্রায়ই ভুলে যাই।
ডাক্তারের ভাগ্নির বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। তার অবতরণিকায় যে কৃতিত্ব সব-কিছু দুরুস্ত-সহি করেছিলুম তাই নিয়ে বেশ একটু আত্মপ্রসাদ–এমনকি দম্ভ বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না– অনুভব করছিলুম। অবশ্য বরপক্ষ যদি একটুখানি লড়াই দিত তা হলে তাদের ঘায়েল করে কৃতিত্ব ও আত্মপ্রসাদ হত পরিতৃপ্তি ভরা। তা ওরা যদি লড়াই না দেয়, তবে আমি তো আর ডকুইকসটের মতো উইন্ডমিল আক্রমণ করতে পারিনে!
কিন্তু শুয়ে শুয়ে সব-কিছু বিচার-বিবেচনা করার পরও যে সুখ পাচ্ছিলুম, সেটা অস্বীকার করব না।
এমন সময় মুচকি মুচকি হেসে শহর-ইয়ার খাটের পৈথানে দাঁড়াল।
বিজয়ী সেনাপতি যেরকম পদাতিকের প্রতি প্রসন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, আমিও ঠিক তেমনি শহর-ইয়ারকে যেন মেহেরবানি মন্জুর করে বললুম, বসতে পারেন।
তার পরই ফাটল আমার ঢাউস বেলুনটা!
শহর-ইয়ার হসিমুখে বললে, বলুন তো, আমরা কতবার আলোচনা করেছি– মুসলমান মেয়েদের পর্দার আড়াল থেকে বেরুনো নিয়ে। পাল্লায় তুলেছি একদিকে সুবিধাগুলো, অন্যদিকে অসুবিধাগুলো এবং যেহেতু আমরা উভয়ই শেষত্তিত ইমানদার সদাগর তাই কখনও আপনি বাটখারার পর বাটখারা চাপিয়ে গেছেন একদিকে, আমি আর অন্য পাল্লায় চাপিয়ে গেছি মালের পর মাল। তার পর হয়তো আপনি চাপিয়েছেন মাল আর আমি বাটখারা। তার অর্থ, আমাদের আলোচনার স্বপক্ষে বিপক্ষে যা যা যুক্তি আমরা বের করেছি কেউ কোনওটা লুকিয়ে রাখিনি। নয় কি?
আমি বললুম, নিশ্চয়ই। এ নিয়ে তো আমরা কেউ কোনওপ্রকারের সন্দেহ এযাবৎ প্রকাশ করিনি। আপনার মনে কি কোনও সন্দেহের উদয় হচ্ছে!
শহর-ইয়ার জিভ কেটে বললে, উপরে আল্লা; সন্দেহের অবকাশ নেই।
আমি শুধু এসেছিলুম আরেকটি অতি সদ্য আবিষ্কৃত যুক্তি নিয়ে যেটা মুসলমান মেয়েদের অন্দর-ত্যাগের সপক্ষে যায়। আপনি তো সেদিন আমাদের ভাগ্নির জন্য অবিশ্বাস্য অঙ্কের স্ত্রীধন, প্রচুর গয়না, এমনকি শেষ পর্যন্ত আইনে টেকে কি না টেকে এমন একটি শর্তও ভাগ্নির সুবিধার জন্য আপনার সুললিত রসনা সঞ্চারণ করে বিস্তর দৌলত জয় করে, রূপকার্থে বলছি, লোহার সিন্দুকে তুলে রাখলেন। আপনার ডাক্তার সে কেরানি দেখে অচৈতন্য। পাছে আপনার ন্যাজ মোটা হয় তাই তার সবিস্তর প্রশস্তিগীতি আর গাইব না। তবে একটি বাক্য আপনাকে শোনাই। তিনি বললেন, এরকম মধুর, ললিত বিদগ্ধ ভাষা ব্যবহার করে মানুষ যে নিষ্ঠুর কাবুলিওলার মতো তার প্রাপ্যের অগুনতি গুণ বেশি চাইতে পারে– এ আমি স্বকর্ণে না শুনলে কখনও বিশ্বাস করতুম না। তা সে যাক্। এইবারে আসল তত্ত্বটি অবহিত চিত্তে শ্রবণ করুন।
আমাদের ভাগ্নি তো তার প্রাচীনপন্থি চাচার সঙ্গে ঝগড়া-কাজিয়া করে যেতে আরম্ভ করল কলেজে অবশ্যই কালো তাবু নামক বোরকা সর্বাঙ্গে লেপ্টে নয়। মেয়েটি যে বেহেশতের হুরীর মতো খাপসুরত, তা নয়– তবে সুশ্রী, স্বাস্থ্যবতী আর চলাফেরায়, কথাবার্তা বলায় হায়া-শরম আছে। লেখাপড়ায় খুব ভালো, প্লেস পাবার সম্ভাবনাও কিছুটা আছে, এবং গোঁড়া চাচাটিকে না জানিয়ে হিন্দু বান্ধবীদের বাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল ইসলাম ও অতুলপ্রসাদের গানও বেশ খানিকটে আয়ত্ত করে ফেলল। গলাটি মিষ্টি, তাই গানের ভুলচুকগুলো ওরই তলায় চাপা পড়ে যায়। চাচাটি অবশ্য এসব কীর্তিকলাপের কিছুই জানেন না, শুধু মাঝে মাঝে দেরিতে বাড়ি ফিরলে একটু-আধটু চোটপাট করেন। তা-ও খুব বেশি না, কারণ তিনি কখনও কলেজে পড়েননি, তদুপরি কুনো মানুষ তাই কলেজের কায়দা-কেতা, এমনিতে কখন কলেজ ছুটি হয়, ফাশন থাকলেই-বা কখন, সে-বিষয়ে সম্পূর্ণ বে-খবর।