আমি বললুম, অত অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে প্রেম হয় না। তার পর কী হল, বলুন।
ডাক্তার বললেন, পাক্কা হক্ কথা বলেছেন। আচ্ছা, তবে এখন পুরনো কথায় ফিরে যাই। বিয়ের সম্মতি পেয়ে আমার মা তো আসমানের চাঁদ হাতে পেলেন। বাড়ির লোকজন পাড়াপড়শি সবাইকে বারবার শোনান যা দিনকাল পড়েছে, আপন গর্ভের সন্তান মায়ের মরার সময় মুখে এক ফোঁটা জল দেয় না। আর আমার জুলফিকার একবার একটা প্রশ্ন পর্যন্ত জিগ্যেস করল না, দুহিন কোথাকার, লেখাপড়ি করেছে কি না, দেখতে কী রকম। বললে, মা, তুমি যখন পছন্দ করেছ, তখন নিশ্চয়ই ভালো হবে। আর সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দিল।
তার পর বুড়ির দিনগুলো কাটল বিয়ের ব্যবস্থা করতে।
আমাদের বিয়ের ঠিক সাত দিন আগে তিনি হার্টফেল করে বিদায় নিলেন।
ডাক্তার অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে থাকার পর বললেন, হ্যাঁ, ওই প্রাচীন যুগের নায়েব সাহেবের কথা হচ্ছিল যিনি যখের মতো এ গোষ্ঠীর বিষয়-সম্পত্তি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আগলিয়েছেন। তিনি নিশ্চয়ই অনেককিছু বলতে পারতেন, কিন্তু বলেননি কারণ আমার দিক থেকে তিনি কখনও কণামাত্র কৌতূহল দেখতে পাননি। আর তিনিই-বা এসব কথা আমার স্মরণে এনে কী আনন্দ পাবেন? ঠাকুদ্দাদের বয়েসী নায়েব সাহেব আমার ঠাকুদ্দার বাবাকেও তার ছেলেবেলায় দেখেছেন, তাঁর জন্ম হলে নাকি আকবরি মোহর দিয়ে তিনি তার মুখ দেখেছিলেন। কারণ তার বাপ ছিলেন আমার ঠাকুন্দার ঠাকুর্দার নায়েব। এবং সেই ঠাকুদ্দার ঠাকুদ্দার আব্বা বানান এই বাড়িটা। তিনি তার ভাই বেরাদর ভাতিজা ভাগিনা, আপন এবং ভাই-ভাতিজাদের শালা-শালাজ জ্ঞাতি-গোষ্ঠী পুষ্যি, মসজিদের ইমাম সায়েব, মোয়াজ্জিন (যে আজান দেয়), পাশের মকতবের গোটা চারেক মৌলবি মকতবটা বহুকাল উঠে গেছে বিষয়-আশয় দেখবার দু পাঁচজন কর্মচারী, ডজনখানেক মাদ্রাসার গরিব ছাত্র নিয়ে এ বাড়িতে থাকতেন। এইটুকু ভাসা-ভাসাভাবে শুনেছি।
কিন্তু মোদ্দা কথা এই : ঠাকুদ্দাদের গোর দেবার সময় আমার অতীত এবং এ বাড়ির অতীতকেও আমি যেন আমার অজান্তে সঙ্গে সঙ্গে গোর দিলুম। বুদ্ধিসুদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার অতীতের প্রতি কৌতূহল, আকর্ষণ দুটোই যেন আরও নিভে যেতে লাগল, বরঞ্চ উল্টো অতীতের প্রতি যেন আমার একটা রোষ জন্মাল। মনে হল সে আমার প্রতি ভয়ঙ্কর অবিচার করেছে। আমাকেও তো সে অনায়াসে মেরে ফেলতে পারত। আমি কি তার যক্ষ যে এ বাড়ি ভূতের মতো আগলাব?
আমার মনে হয়, বুড়ো নায়েব এবং পাড়ার পাঁচবুড়ো আমার চোখেমুখে অতীতের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা দেখতে পেতেন এবং তাই স্বেচ্ছায় ওই পাঁক ঘ্যাঁটাতেন না।
আর বলতে গেলে তারা বলবেনই-বা কী? সেই ১৮২৫-এর গমগমে বাড়ি কী করে একজনাতে এসে ঠেকল। একজন একজন করে সক্কলের বংশলোপ পেল– এ ছাড়া আর কী? আপনিই বলুন, সে-সব শুনতে কার ইচ্ছে যায়?
তবে হ্যাঁ, কারও যদি ইচ্ছে যায় পুরো ইতিহাসটা গড়ে তোলবার, তবে সে সেটা করতে পারে কিন্তু বিস্তর তকলিফ বরদাশত করার পর। নিচেরতলায় এল উইঙের শেষ দু খানা ঘরে আছে, যাকে বলতে পারেন আমাদের পারিবারিক আরকাইভ অর্থাৎ মহাফেজখানা। ১৭৮০ বা ৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত যেমন যেমন দলিল-দস্তাবেজ, চিঠিপত্রের আদান-প্রদান, জমা-খরচের হিসেব-নিকেশ, কর্মচারীদের রিপোর্ট, মোকদ্দমা সংক্রান্ত কাগজ এবং আরও শত রকমের ভিন্ন ভিন্ন কাগজপত্র, টুকিটাকি প্র্যাকটিক্যাল কারবার-ব্যবসায়ের জন্য বেকার হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো রেখে দেওয়া হয় ওই দু খানা ঘরে। বেশ যত্নের সঙ্গেই রাখা হয়েছে, এবং পুরুষানুক্রমে নায়েবরাও সেগুলোর যত্ন নেন। শহর-ইয়ারও মাস তিনেক অন্তর অন্তর সেগুলোর তদারক করে। আমার লজ্জা পাওয়া উচিত, আমার কিন্তু মাষা পরিমাণ দিল-চপি এসব কাগজপত্রের প্রতি নেই।
আমি চুপ করে ভাবলুম এবং ডাক্তারকে মোটেই কোনও দোষ দিতে পারলুম না। যে অতীত তাঁর গোষ্ঠীর সবকিছু নির্মমভাবে কেড়ে নিয়েছে তাকে আবার যত্নআত্তি করে পুঁথির পাতায় লেখার কী প্রয়োজন? এবং এর সঙ্গে আরেকটা তত্ত্ব বিজড়িত আছে। পরিবারের অতীত ইতিহাস নিয়ে যারা নাড়া-চাড়া করে তাদের বেশিরভাগই কেমন যেন পূর্ব ইতিহাসের স্মরণে বেশকিছুটা দম্ভী হয়ে যায়। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমাদের ডাক্তার তো ফকির, সুফির বিনয় আচরণ ধরেন, সংসারে থেকে, গৃহীরূপে।
একটু প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধি দেখিয়ে শুধালুম, এই যে শূন্য অন্ধকার একতলা, দোতলার একটা পুরো উইং, তেতলা–এগুলোর একটা ব্যবস্থা করেন না কেন?
কী ব্যবস্থা? ভাড়া দেওয়া ছাড়া আর গতি কী? কলকাতায় আমার যেসব বাড়ি ভাড়ায় খাটছে তার আমদানিই আমাদের দু জনার পক্ষে যথেষ্টেরও ঢের ঢের বেশি। পরিবার যে অনতিবিলম্বে বৃহত্তর হবে তার সম্ভাবনাও তো দেখছিনে।
এর পর ডাক্তার কী বলেছিলেন সেটা আমি সম্পূর্ণ মিস করলুম, কারণ আমার মনে তখন অদম্য ইচ্ছা যে তাঁকে শুধাই : দশ বছর হল তাদের বিয়ে হয়েছে, এখনও কোনও বংশধর না আসার কারণ কী? তিনি স্বয়ং ডাক্তার, তিনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে পারেন, প্রয়োজন হলে বিদেশে যেতে পারেন, কিন্তু ইচ্ছেটা অতি কষ্টে দমন করলুম। আমি ভীরু; যদি কোনও অপ্রিয় সংবাদ শুনতে হয়।