সবাই সমস্বরে তখন আমাকে অনুরোধ করলেন আমি যেন আল্লার কাছে শুকরিয়া জানিয়ে একটি মোনাজাত (প্রার্থনা) করি। এসব মোল্লাদের (পুরুদের) কাজ,- তারা দু পয়সা পায়ও এসব আমাদের (অর্থাৎ স্মৃতি-রত্নদের) কাজ নয়। তবু অতিশয় প্রসন্ন চিত্তে আল্লাকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রার্থনা সমাপ্ত করলুম।
১০. অতি বৃদ্ধ মুরুব্বির কোলে বসে
১০.
ডাক্তার বললেন, আমার খুব ছেলেবেলায় এ বাড়ির দু তিনজন অতি বৃদ্ধ মুরুব্বির কোলে বসে তাঁদের আদর পেয়েছি, আর মনে আছে, আমাকে আদর করতে করতে হঠাৎ তারা কেঁদে ফেলতেন। আমি তখন এই বিরাট বাড়ির বিরাট গোষ্ঠীর একমাত্র সন্তান। আপনি যে-সব প্রশ্ন শুধালেন, এর অধিকাংশের উত্তর এই মুরুব্বিরা নিশ্চয়ই জানতেন, কিন্তু আমি তখন এতই অবোধ শিশু যে আমাকে তারা প্রাচীন দিনের কোনও কাহিনীই বলেননি।
একটু অপ্রতিভ হাসি হেসে বললেন, কিন্তু এই বৃদ্ধেরা একটা গভীর পরিতৃপ্তি সঙ্গে নিয়েই ওপারে গেছেন। ওই নিতান্ত শিশুবয়সেই আমি ওঁদের নামাজের সময় তাদের পাশে দাঁড়িয়ে, বসে, সজদা দিয়ে তাঁদের অনুকরণ করতুম, তাঁদের কোলে বসে মসজিদে যেতুম, আর বাড়িতে শিরনি বিলোবার সময় সদর দরজায় তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতুম। আমাকে তারা তখন একটা খুব উঁচু কুর্সিতে বসিয়ে জমায়েত গরিব দুঃখী, নায়েব-গোমস্তা সবাইকে বলতেন, ইনিই বাড়ির মালিক; এঁর হুকুমমতো চললে আমাদের দোওয়া তোমাদের ওপর থাকবে। আর সবচেয়ে মজার কথা কি জানেন, সৈয়দ সাহেব, আমার আপন ঠাকুদ্দার বড় ভাইসাহেব, যিনি তখন বাড়ি চালাতেন, তিনি প্রায় প্রতিদিন আমার পড়ার ঘরে এসে বলতেন ভাইয়া, শোনো। মির্জাপুর (উনি অবশ্য মীরজাফর-ই বলতেন) অঞ্চলে আজ আরেকটা বাড়ি কেনা হল। ঠিক আছে তো? কিংবা ওই ধরনের ব্যবসায় সংক্রান্ত কিছু-একটা। আজ ওই ছবিটা যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখন হাসি পায়। ঠাকুদ্দা খবরটা দেবার সময় ভাবখানা করতেন, যেন তিনি আমার নায়েব, কিছু একটা করে এসে হুজুরের পাকা সম্মতি চাইছেন! এরকম একাধিক ছবি আমার চোখের সামনে এখনও আবছা-আবছা ভাসে।
ছ মাসের ভিতর তিন ঠাকুদ্দাকেই গোরস্তানে রেখে এলুম। আমার তখনকার শিশুমনের অবস্থা আপনাকে বোঝাবার চেষ্টা করব না।
ওই যে পুরো একটা উইং জুড়ে রোজ সন্ধ্যায় সাজানো-গোছানো ঘরে আলো জ্বলে তাঁরা ওইখানে বাস করতেন, তাঁদের আপন আপন শ্বশুরবাড়ির কিংবা ওই ধরনের কিছু কিছু জ্ঞাতি-গোষ্ঠী নিয়ে। বহু বৎসর পরে আমাদের প্রাচীন দিনের নায়েব সাহেব আমাকে বলেন, ওই বুড়া ঠাকুদ্দারা তাদের মৃত্যুর বছরখানেক আগে কলকাতার অন্যত্র পুষ্যিদের জন্য ভালো ব্যবস্থা করে দেন, ঠাকুন্দারা নাকি চাননি যে তাঁরা এ বাড়িতে পরবর্তীকালে আমার কোনও অসুবিধার সৃষ্টি করেন।
আমি শুধালুম, এই নায়েব নিশ্চয়ই বৃদ্ধ বয়সে মারা যান। তিনি আপনাকে প্রাচীন দিনের কোনও কাহিনী বলেননি? পাড়ার আর পাঁচ বুড়ো?
কী করে বোঝাই, ডাক্তার সাহেব, বাপ-মা, আমার আপন ঠাকুন্দা নিয়ে চারজন ঠাকুদ্দা– আমার আপন ঠাকুদ্দা আর পাঁচজন চাচা মারা যান আমার জন্মের পূর্বে এদের সবাইকে হারিয়ে ছ বছর বয়েস থেকে আমি একা এই বিশাল বাড়িতে একা। শুধু নায়েব সাহেবের ক্ষুদ্র পরিবার এবং তাঁর এক বিধবা পুত্রবধূ- ইনিই আমাকে মানুষ করেন আপন ছেলের মতো করে। কিন্তু আমার এমনই কিস্মাৎ, এঁরাও সবাই চলে গেলেন ওপারে– ততদিনে আমি মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারে। বাকি রইলেন, শুধু আমার ওই মা-টি। তাঁকেও হারালুম এমন এক সময় যে আমি রাত্রে হাউ হাউ করে কেঁদেছি। এই মা আমার আত্মগোপন করে শহর-ইয়ারকে গোপনে দেখে এসে আমাকে বললেন, জুলফিকার, আমি নিজে দুলহিন দেখে তোর বিয়ে ঠিক করে এসেছি। এইবারে তুই রাজি হলেই আমি পাকা খবর পাঠাই। আমি জানতুম, ওই নিঃসন্তান বৃদ্ধার ওই একটিমাত্র শেষ শখ। তার সঙ্গে আমার কোনও রক্তসম্পর্ক নেই, সুদূরতম আত্মীয়তাও নেই, অথচ তিনি আমাকে দিনে দিনে মানুষ করে তুলেছেন সামান্যতম প্রতিদানের চিন্তা পর্যন্ত না করে– ঘোর নেমকহারামি হত এর শেষ আশা পূর্ণ না করলে। আর বিয়ে তো করতেই হবে একদিন– বংশরক্ষা করার জন্য, অন্য কোনও কারণ থাক আর নাই বা থাক্। বিয়ে না করলে আমার পিতৃপুরুষ পরলোক থেকে আমাকে অভিসম্পাত দেবেন, এ কুসংস্কার আমার নেই; কিন্তু তারা যতদিন এ লোকে ছিলেন ততদিন আমিই, একমাত্র আমিই যে তাদের শেষ আশা, আমিই তাঁদের বংশরক্ষা করব– সে আশা যে এ বাড়ির বাতাসের সঙ্গে গিয়ে মিশে প্রতি মুহূর্তে আমার প্রতিটি নিশ্বাসের সঙ্গে আমাকে প্রাণবায়ু দিচ্ছে। এক মুহূর্ত চিন্তা না করে সম্মতি দিলুম।
আমি শুধালুম, ইতোমধ্যে আপনি প্রেমেট্রেমে পড়েননি? কলকাতার ডাক্তারি শিক্ষাবিভাগ পাছে আমার বিরুদ্ধে মানহানির মোকদ্দমা করে তাই সভয়ে বলছি, অন্যদের তুলনায় প্রেমট্রেম করার সুবিধে আপনাদেরই তো বেশি। আর আপনার চেহারা, ধনদৌলত–।
হেসে বললেন, প্রেমট্রেম হয়নি তবে মাঝে মাঝে যে চিত্তচাঞ্চল্য হয়নি একথা অস্বীকার করলে গুনাহ্ হবে। তবে কি জানেন, আমি যে মুসলমান সে বিষয়ে আমি সচেতন এবং তাই নিয়ে আমার গর্ববোধ আছে। ওদিকে হিন্দুরা নিজেদের মুসলমানের চাইতে শ্রেষ্ঠতর মনে করেন। সেটা নিতান্তই স্বাভাবিক। প্রত্যেক জাতই একট্রিম এবনরমেল কন্ডিশন না হলে নিজেকে অন্য জাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে। অবশ্য এসব বাবদে সম্পূর্ণ উদাসীন মহাজনও কিছু কিছু সবসময়ই পাওয়া যায়। আমার সহপাঠী-সহকর্মী প্রায় সবাই হিন্দু, কিছু কিছু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, যে দু একজন মুসলমান তারা থাকেন হোস্টেলে। কয়েকজন হিন্দুর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হয়– এখনও আছে এবং তারা অত্যন্ত সজ্জন বলে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মা-বোনদের সঙ্গে আলাপও করিয়ে দেন। সেখানে প্রেম করে হিন্দু পরিবারে বিপর্যয় কাণ্ড বাধাবার কোনও বাসনাই আমার ছিল না– তদুপরি কোনও হিন্দু তরুণী যে আমার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছেন সেটাও আমার গোচরে আসেনি।