এ জাতীয় আলোচনা সবসময়ই আরম্ভ হয় মহর বা স্ত্রীধনের পরিমাণ নিয়ে। কনের দিদির স্ত্রীধন পনেরো হাজার ছিল, তারই স্মরণে গুনগুন করলুম, কুড়ি হাজার।
আমি ছিলুম তৈরি যে তাঁরা মৃদুহাস্য করে অতিশয় ভদ্রতা সহকারে দশ হাজার দিয়ে দর-কষাকষি আরম্ভ করবেন। ইয়া আল্লা! কোথায় কী? দু জনাই অতি প্রসন্ন বদনে সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে নিলেন! আমি তো সাত হাত পানিমে!
মৃদুকণ্ঠে বললুম, আপনারা তো সবই জানেন, কনের বাড়ির হালও জানেন; গয়নাগাটি আমরা আর কী দেব! আপনারাই বরঞ্চ একটা আন্দাজ দিন!
ফের ফাটল বম্-শেল! দু জনাই সাততাড়াতাড়ি বললেন, এ কী বলছেন, সাহেব। না, না, না। আপনারা যা খুশ দিলে দেবেন আমাদের পক্ষে সেইটেই গণিমত (বৈভব, সৌভাগ্য)।
তার পর ওঁরা নিজের থেকে যা বললেন তা শুনে, বিশেষ করে থার্টি ইয়ারস উয়োরের স্মরণে, আমি আমার কানদুটোকে বিশ্বাস করতে পারলুম না। ওঁরা কনেকে কী গয়নাগাটি দেবেন সে প্রশ্ন ইতিউতি করে আমি শুধোবার পূর্বেই তারাই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বললেন, মাফ করবেন, আর আমাদের পক্ষ থেকে তো বলার কিছুই নেই। আপনারা জানেন দুলহার (বরের) ভাইবোন নেই। কাজেই দুলুহিনই শাড়ির সবকিছু পাবেন এ তো জানা কথা, আর আমরাও সেই কথাই দিচ্ছি। তার দাম ভদ্রলোক সঙ্গীকে শুধোলেন, কত হবে ভায়া? সঙ্গী বললেন, হালে যাচাই করা হয়েছিল। কুড়ি হাজারের কম না। তিন পুরুষের পুরনো গয়ন, নতুন করে গড়াতে হবে।
কুড়ি হাজার বলে কী! কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তড়িঘড়ি বললুম, অমন কম্মটি করতে যাবেন না। আল্লার মেহেরবানিতে ভালোয় ভালোয় আকৃৎ-রসুমাৎ (পরিপূর্ণ শাদি) হয়ে যাক তখন না হয় দুলহিন তার শাশুড়ির সঙ্গে পরামর্শ করে যা করার করবেন। কী বলেন ডাক্তার? আর আপনারা?
দু জনেই সানন্দে সায় দিয়ে, একজন বললেন, আমার মেয়ে বলছিল, পুরনো ফ্যাশান নাকি আবার হালফ্যাশান হচ্ছে। এখন ভেঙে গড়ালে পরে হয়তো দুলহিনই– কথাটা তিনি আর শেষ করলেন না।
ইতোমধ্যে নাশতা আসতে আরম্ভ করেছে। সে আসা আর শেষ হয় না। নাশতা না বলে এটাকে হক-মাফিক ব্যানকুয়েট বলা উচিত। বরপক্ষ ক্রমাগত আমাদের শুনিয়ে একে অন্যকে বলে চলেছেন, হবে না কেন? চিরকালই হয়ে আসছে এরকম। এঁয়ার ওয়ালেদের (পিতার) আমলে আমি কতবার খেয়েছি এরকম। আমার দাদাকে (ঠাকুদ্দা) কতশত বার বলতে শুনেছি, এঁয়ার ঠাকুরদ্দার শাদির দাওয়াত! তিন রকমের খানা তাইয়ার হয়েছিল। তিন বাবুর্চির একজন এসেছিল পাটনা থেকে, অন্যজন দিল্লি থেকে আর তিসরা হায়দ্রাবাদ নিজামের খাস বাবুর্চি-খানা থেকে। আর চলল তো চলল– তার যেন শেষ নেই।
নাশতার বাসন-বর্তন খাওয়াদাওয়ার পর যখন সরিয়ে নেওয়া হল তখন আমি অতিশয় মোলায়েম সুরে বললুম, আমার একটি আরজ আছে; যদি অভয় দেন
উভয়ে সমস্বরে বললেন, আপনি আরজ না, হুক করুন।
আমি বললাম, আমি যা বলতে যাচ্ছি সেটা বোধ হয় আদালতে টেকে না। কুরান শরিফের কানুন মোতাবেক যে কোনও মুসলমান চারিটি বিবি একই সময়ে রাখতে পারে। এখন আমরা যদি কাবি-নামায় দুলহার কাছে শর্ত নিই অর্থাৎ আপনারা যদি মেহেরবানি করে সে শর্ত কবুল করেন যে তিনি দুলহিনের বিনা অনুমতিতে দুসরি শাদি করবেন না, তবে আইনত সেটা বোধ হয় আস্ট্রা ভাইরে। আদালত খুব সম্ভব বলবে, কুরান শরিফ মুসলিমকে যে হক দিয়েছেন, মানুষ একে অন্যের কাছ থেকে শর্ত আদায় করে সে হক খর্ব করতে পারে না। আমি এতক্ষণ ধরে এই সমস্যাটা নিয়ে চিন্তা করছিলুম।
কন্যাপক্ষ বললেন, আমরা খুশির সঙ্গে সে শর্ত দেব। সে শর্ত আপনাদের তরফ থেকে নিতে তো কোনও দোষ নেই। তার মূল্য শেষ পর্যন্ত যদি না থাকে তো নেই। এখন নিতে আপত্তি কী?
সমস্ত বাক্যালাপটা আমার কাছে অত্যন্ত অবাস্তব ঠেকছিল। কোথায় গেল সেই ত্রিশ বৎসর পূর্বেকার লড়াই? আলোচনার নামে চিৎকার, রাগারাগি, নাশতা স্পর্শ না করে বরপক্ষের সত্যাগ; এমনকি বিয়ের রাত্রেও উভয় পক্ষ ততদিনে বিয়ের প্রস্তুতির জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করে ফেলেছেন– কাবিন্-নামা লেখার সময় সামান্য একটা শর্ত নিয়ে বচসা, তার পর মারামারি, সর্বশেষে বিয়ে ভণ্ডুল করে বরপক্ষ বাড়ি যাবার পথে অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে বিবাহ-পর্ব সমাধান করে মুখরক্ষা করল– এ ব্যাপারও মাঝে মাঝে হয়েছে।
আর আজ দেখি ঠিক তার উল্টো! আমি যা শর্ত চাই সেটাতেই তারা রাজি! যেন সমস্ত কলকাতা শহরে আর কোনও বিবাহযোগ্যা কুমারী নেই! এই ত্রিশ বছরে দুনিয়াটা কি আগাপাশতলা বদলে গেল?
এ অবস্থায় আর খাই বাড়ানো চামারের আচরণ হবে। শুধু বললুম, আর বাকি যেসব ছোটখাটো শর্ত আছে, যেমন আমাদের মেয়ে যদি আল্লা না করুক– শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে মনোমালিন্য হেতু বাপের বাড়িতে এসে কিছুকাল বা দীর্ঘকাল বাস করে তবে সে শ্বশুরবাড়ি থেকে কত টাকা মাসোহারা পাবে, আপনারা যে স্ত্রীধন দেবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবেন তার জিম্মাদার কে কে হবেন, এ সবের জন্য আর চিন্তা করতে হবে না। বিয়ের পূর্বে আমাদের উকিলের সঙ্গে আপনাদের উকিল বসে এসব ফর্মালিটিগুলো দুরস্ত করে নেবেন। আজ আমি এতই খুশি যে বিনা তর্কে বিনা বাধায় বড় বড় শর্তগুলো সম্বন্ধে একমত হতে পেরেছি যে অন্য আর কোনও ছোট শর্ত স্পর্শ করতে চাইনে।