আমার কথা শুনে দু জনাই এমন হাসি লাগালেন যে তার আর শেষই হয় না। ডাক্তার তার বউকে সঙ্গে সঙ্গে কী যে বলছেন সেটা আমার ঠাহর হল না। পরে শুনলুম বলছেন, ঠিক আমার আপন মামুর মতো, হুবহু যেন আমার আপন মামু এ কথাগুলো কইলেন। তুমি তাকে দেখোনি শহর-ইয়ার তিনি চলে যান আমি যখন ম্যাট্রিকে। কী দম্ভ, কী দেমাক ছিল ভদ্রলোকের! কিন্তু ওই একমাত্র বিয়ের আলাপের সময়। অন্য সময় মাটির মানুষ বললেও কমিয়ে বলা হয়। আর তার দোস্তি ছিল কাদের সঙ্গে, জানো? দুনিয়ার যত মুটেমজুর, গাড়োয়ান-বিড়িওলার সঙ্গে। তিনি গত হলে পর আমরা তো বেশ জাঁকজমক করে তার ফাতিহা (শ্রাদ্ধ) করলুম, আর বিশ্বাস করবে না, শহর-ইয়ার, আরেকটা আলাদা করল তার টাঙাওলা-বিড়িওলা দোস্তরা– দু পয়সা, চার পয়সা করে চাঁদা তুলে তুলে।
আমি বললুম, নিশ্চয়ই অত্যন্ত খানদানি ঘরের শরিফ আদমি ছিলেন।
ডাক্তার বললেন, দি বেস্ট না হলেও ওয়ান অব দি ভেরি বেস্ট ইন মুর্শিদাবাদ। কিন্তু আপনি আঁচলেন কী করে।
উচ্চতম স্তরের লোক ভিন্ন অন্য কেউ নিম্নতম স্তরের সঙ্গে মেশবার হিম্মত কলিজায় ধরে না।
ডাক্তার বললেন, সে তো বুঝলুম, কিন্তু আপনি, স্যার, কি এখনও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাস করেন?
আমি বললুম, ঠিক তার উল্টো। আমি বিংশ শতাব্দীও পেরিয়ে গিয়েছি। যে কোনওপ্রকারেই হোক মেয়েকে বিয়ে দিতেই হবে এই মান্ধাতার আমলের কুসংস্কার আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু এ নিয়ে আলোচনা পরে হবে। ওনারা আসবেন কখন?
দেরি নেই, এনি মিনিট।
তা হলে তাড়াতাড়ি জেনে নিই। কনের মার মহর (স্ত্রীধন) কত ছিল?
ডাক্তার ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বললেন, তাই-তো। ওদের আবার ফোন নেই যে শুধব।
শহর-ইয়ার বললে, দশ হাজার।
সঙ্গে সেকুরিটি হিসেবে জমি-জমা, কলকাতার কোনও স্থাবর সম্পত্তি?
না।
মুহম্মদি চার শর্ত ছাড়া অন্য কোনও শর্ত ছিল যেটা বর ভাঙলে মেয়ে তালাক চাইতে পারবে।
না।
কনের কোনও ভাই-বোন আছে?
একটি দিদি ছিল। বিয়ের অল্পদিন পরেই মারা যায়।
কাবিন্-নামায় (ম্যারেজ কন্ট্রাক্টে) ওর স্ত্রীধন (মহর) কত ছিল?
হাজার পনেরো।
ওরা কত গয়না দিয়েছিল?
হাজার তিনেকের।
আর আমরা?
ওই হাজার তিনেক। তবে জেহজের খাটতোশক, ড্রেসিং টেবিল, পেতলের কলসিটলসি নিয়ে হাজার পাঁচেক হবে।
শহর-ইয়ারই সবকটা উত্তর দিল।
ডাক্তার সত্যই একটা নিষ্কর্মা খোদার খাসি। ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু আমাদের কথাবার্তা শোনে আর তাকানোর ভাব থেকে অতি স্পষ্ট বোঝা যায়, এসব প্রশ্নোত্তরের তাৎপর্য তার মস্তকে আদৌ প্রবেশ করেনি।
শহর-ইয়ারকে শুধালুম, বরের বাড়ির মেয়েরা হরেদরে কত স্ত্রীধন পেয়েছে এবং বরেরা আপন আপন দুহিনকে (কনেকে) কত টাকার গয়নাগাটি দিয়েছে সেটা বোধ হয় জানেন না এবং আমাদের সুচতুর ডাক্তারও সে খবর গোপনে গোপনে সংগ্রহ করেননি। না?
আমার অনুমান সত্য।
ডাক্তার মেয়েটি কী কী পাস দিয়েছে, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে কি না এসব খবর দিতে আরম্ভ করেছেন। আমি বললুম, ওসব জেনে কী হবে? তার জোরে স্ত্রীধন বাড়াবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বরপক্ষ তাদের অন্যান্য ছেলের বিয়েতে কাবিন্-নামায় কনেপক্ষের প্যাঁচের টাইটে কী কী দিয়েছে সেটা জানতে পারলে, বেটার স্টিল ওদের দু চারখানা কাবিন্-নামার কপি যদি গোপনে গোপনে যোগাড় করে রাখতেন তবে সেগুলো হত আমার অ্যাট বম্। এখন যা অবস্থা, মনে হচ্ছে, গাদা বন্দুকটি পর্যন্ত হাতে নেই।
প্রাইজ-ইডিয়ট আর কারে কয়! ডাক্তার বলে কি না, বরপক্ষকে শুধোলেই তো সব জানা যাবে।
আমার কান্না পাবার উপক্রম। বললুম, ওরা জলজ্যান্ত মিথ্যে খবর দেবে। আর আমিও কনেপক্ষের সুবিধের জন্যে যে থান্ডারিং মিথ্যে বলব না, সে প্রতিজ্ঞাও করছিনে।
শহর-ইয়ারকে শুধালুম, আপনি আমাদের সঙ্গে বসবেন?
না।
একসেলেন্ট! কিন্তু আপনি কোথাও পালাবেন না। কোনও খবরের দরকার হলে আপনার কাছে কোনও অছিলায় চলে আসব।
আমি ওঁদের জন্যে খাবার-দাবার তৈরি করার তদারকিতে থাকব।
বেয়ারা খবর দিল ওঁরা এসেছেন। ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেলেন। আমি পা বাড়াতেই শহর-ইয়ার দুষ্টু মুচকি হাসি হেসে বললে, আপনাকে যে কত রূপেই না দেখব! এখন দেখছি ঘটকরূপে। এ-ও এক নব রূপ।
গুনগুন করে গান ধরল–
তুমি নব নব রূপে এস প্রাণে
ডাক্তার মহা সাড়ম্বরে বরপক্ষের দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন এবং বললেন, আমি যে কনেপক্ষের হয়ে এই আলোচনায় যোগ দিতে রাজি হয়েছি তার জন্য তিনি এবং তার পরিবার নিজেকে অত্যন্ত গর্বিত অনুভব করছেন। কনেপক্ষের দু জনও তাদের আনন্দ প্রকাশ করলেন এবং বললেন, আমার নাম তাদের গোষ্ঠীতে অজানা নয়।
ডাক্তার বললেন, ইনি আছেন বলে আমার আর কোনও দুশ্চিন্তা নেই যে, আমরা অতি সহজেই সব বিষয়েই একমত হয়ে যেতে পারব।
আমি এ জাতীয় অদৃশ্য সশস্ত্র সংগ্রাম- অজ্ঞজন যাকে বলে বিবাহের শর্তগুলো স্থির করার জন্য বর ও কনে পক্ষের মধ্যে আলোচনা শেষবারের মতো দেখেছি দেশে। তার পর দু একটি বিয়ে-শাদিতে আনুষ্ঠানিকভাবে পেট ভরে খেয়ে এসেছি– ব্যস্।
আমি সেই ত্রিশ বৎসর পূর্বেকার শেষ অদৃশ্য সশস্ত্র সগ্রামে আমার অদৃশ্য তলওয়ারটাতে শান দিতে লাগলুম।
কিন্তু হা কপাল! সব বেকার, সব বরবাদ, সব ভণ্ডল।