বুঝলে শহর-ইয়ার, একেই বলে টায়-টায় জিল্টে লাভ। তামাম বিশ্বসাহিত্য তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও এই হতভাগিনী জিল্টে শ্রীরাধার শত যোজন কাছে আসতে পারে এমন রিক্তা হৃতসর্বস্ব তুমি পাবে না।
তাই আকারে, গাম্ভীর্যে, মহিমায় হিমালয়ের মতো বিরাট কলেবর বৈষ্ণব সাহিত্যের মূল সুর- লাইট-মোতিফ- জিল্টে লাভ, পদদলিত প্রেম।
সে সাহিত্যে দুঃখিনী শ্রীরাধার হৃদয়-বেদনা যে কত কবি কত দিক দিয়ে দেখেছেন, কত ভাবে বর্ণনা করেছেন, তার সামান্যতম অংশ কেউ অন্যের হৃদয়ে সঞ্চারিত করতে পারবে না। শ্রীরামকৃষ্ণ ঠিক ঠিক কী বলেছেন বই না খুলে বলা যায় না, তবে যা বলেছেন তার সারাংশ এই, মদ দেখলে নেশা হয় না, শুঁকলেও না, চাখলেও না, এমনকি সর্বাঙ্গে মাখলেও না। মদ গিলতে হয়।
পদাবলিরস আকণ্ঠ গিলতে হয়।
.
০৯.
আজ রোববার। সপ্তাহে মাত্র এই একটি দিন ডাক্তার আর শহর-ইয়ার একে অন্যকে নিরবচ্ছিন্নরূপে পায়। এ দিনটায় আমি দ্য ত্রো– ওয়ান টু মেনি হতে চাইনে। তাই ব্রেকফাস্টে পর্যন্ত গেলুম না। খাই তো কুল্লে দু কাপ চা সে কর্মটি শুয়ে শুয়ে দিব্যি করা যায়। মোগলাই কণ্ঠে বেয়ারাকে চা আনতে হুকুম দিলুম। কিন্তু উল্টা বুঝলি রাম। চায়ের সঙ্গে সঙ্গে এলেন কপোত-কপোতী। ডাক্তারের মুখে পুরো উদ্বেগ। ঢুকেই নার্ভাস কণ্ঠে দ্রুতগতিতে বলতে লাগলেন, আপনার কী হয়েছে? শরীর খারাপ? জ্বর? ব্যথাট্যথা? শহর-ইয়ার খাটের পৈথানে কাঠের বাজু ধরে শুধু তাকিয়ে আছে। তার মুখে উদ্বেগের কোনও চিহ্ন নেই।
আমি ভালো করে কিছু বলার পূর্বেই ডাক্তার খাটের বাজুতে বসে আমার হাতখানা আপন হাতে তুলে নিয়ে বললেন, আমি প্রথম দিনই স্থির করেছিলুম সুযোগমতো আপনার শরীরটা একটু দেখে নেব। এইবেলা সেটা করা যাক। আজ রোববার, বেশ আহিন্তা আহিস্তা রতা রফতা।
আমি দ্রুতগতিতে বোঝাতে চেষ্টা করলুম, আমার স্বাস্থ্যটা পুরুষ্টু পাঁঠার মতো, হজম করতে পারি ভেজালতম তেল, নিদ্রা ভিলেজ ইডিয়টের চেয়ে গভীরতর ভুল বললুম, বলা উচিত ছিল রোদের পুলিশের চেয়েও। ডাক্তার কোনওপ্রকারের আপত্তি না জানিয়ে, প্রশান্ত নিঃশব্দ হাসি মারফত প্রসন্নতা প্রকাশ করে আমার দেহটি বদখলে এনে তাঁর ইচ্ছামতো উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলেন, যেন ঘড়েল ক্যাশিয়ার হাজার টাকার নোটের কোনও না কোনও জালের চিহ্ন খুঁজে বের করবেই করবে– কারণ ইতোমধ্যে, স্বামীর আদেশ হওয়ার পূর্বেই শহর-ইয়ার স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ব্লাডপ্রেশারের যন্ত্র, স্টিতস্কোপ এবং আরও কিছু আমার অচেনা যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছেন।
সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার একাধিকবার বললেন, আমি ডাক্তারি ভুলে গিয়েছি সেকথা তো আপনাকে বলেছি। এটা নিছক, প্রাথমিক আনাড়ি পরীক্ষা। পরে আমার এক বন্ধু এসে পাকাভাবে দেখে যাবেন।
আমি বললুম, আমি কী হিন্দুসমাজের অরক্ষণীয়া যে আমাকে কাঁচা-দেখা-পাকা দেখা সব জুলুমই সইতে হবে?
ডাক্তার খুশিমুখে বললেন, ভালোই হল, ওই কনে-দেখার কথাটা উঠল। আপনার কাছে আমার একটা সবিনয় আরজ আছে। কিন্তু আপনার যদি কণামাত্র আপত্তি থাকে তবে আপনি দয়া করে অসঙ্কোচে আপনার অসম্মতি জানিয়ে দেবেন। আমি কথা দিচ্ছি, আমি নিরাশ হব না।
আমি বললুম, অত তকলুফ করেন কেন? বলুন না খুলে।
খোঁড়াদের চলার মতো ইনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কথা বললেন। মানে, অর্থাৎ, ব্যাপারটা হচ্ছে এই; আমার অতি দূরসম্পর্কের একটি ভাগ্নি আছে। বাপ-মা নেই- অরক্ষণীয়া বলা যেতে পারে। আপনাদের অঞ্চলে বিয়ের প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা কী পদ্ধতিতে হয় আমার জানা নেই। এ অঞ্চলে কিন্তু কনেপক্ষ কখনওই বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় না– সে বড় শরমের কথা। হিন্দুদের মতো প্রোফেশনাল ঘটকও আমাদের নেই। তাই চতুর্দিকে আটঘাট বেঁধে কনের মামার ভায়রা-ভাইয়ের ভগ্নীপতি, পারলে তার চেয়েও দূরসম্পর্কের কেউ তার কোনও বন্ধুকে আত্মীয়কে নয়– বরের ভগ্নীপতির মেসোমশায়ের বেয়াইয়ের কোনও বন্ধুকে যেন ইঙ্গিত দেয় এই বিয়েটা সম্বন্ধে। তার পর স্টেপ বাই স্টেপ সেটা এগোয়। সেগুলো না হয় না-ই বললুম। এক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। আজ সকালে বরের এক নিকটআত্মীয় এখানে আসছেন– ভদ্রলোক আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত নন- কথাবার্তা আরেকটুখানি পাকাপাকি করার জন্য। আপনি তো জানেন, এসব দুনিয়াদারি বাদে আমি একটি আস্ত গাধা। তাই আপনি যদি সেখানে।
আমি বললুম, আমি সানন্দে উপস্থিত থেকে আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত, কিন্তু বিপদ কী জানেন, আমি এসব ক্ষেত্রে অত্যন্ত অভিমানী। আলোচনার সময় যদি আমার কখনও মনে হয়, বরপক্ষ আমাদের কনেকে যেন নিতান্ত মেহেরবানি করে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন কিংবা থাক্, অর্থাৎ বাংলা কথায়, কনে কিংবা তার আর্থিক অবস্থা অথবা তার বংশমর্যাদা সম্বন্ধে কোনওপ্রকারের সামান্যতম কটাক্ষ যদি বরপক্ষ করে তবে লেগে যাবে ফৌজদারি। আমি খুব ভালো করেই জানি, সেক্ষেত্রে আমার সভাস্থল পরিত্যাগ করা উচিত, কারণ আলোচনা চালু রাখার জন্যে তো অন্য মুরুব্বিরাও রয়েছেন, কিন্তু আমি পারি না, আমি ত্রিভুবন অন্ধকার দেখি ও আমার ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে যেন ধুয়ো বেরুতে থাকে। অতএব বড়ই প্রয়োজনীয় প্রশ্ন, আলোচনায় আমার যোগদান করাটা কি আপনাদের পক্ষে বাঞ্ছনীয়?