তার পর বহুবার শুনেছি সন্ধ্যা আটটা-দশটা থেকে ভোর অবধি কীর্তন গান। তার বর্ণনা আপনাকে আরেকদিন দেব। এদেশ থেকে বহু উত্তম উত্তম প্রথা প্রতিদিন লোপ পাচ্ছে; আমার গভীরতম শোক, দুর্নিবার হাহাকার– যার কোনও সান্ত্বনা নেই যে সমস্ত রাত ধরে কীর্তন গান গাওয়ার প্রথা প্রায় সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে। আমার মতামতের কী মূল্য? তবু যাবার পূর্বে নিবেদন করে যাই, ওইটেই ছিল বাঙলার সর্বাপেক্ষা মূল্যবান ঐতিহ্যগত সম্পদ- এর লক্ষ যোজন কাছে আর কোনও সম্পদ কোনও বৈভব আসতে পারে না।
বিবেকানন্দ কুমড়ো গড়াগড়ি কথাটা একাধিকবার ব্যবহার করেছেন– কারণ ছবিটা যেন চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে।
কীর্তনের আসরে ছেলে-বুড়ো রাধার বিরহবেদনা শুনে কুমড়ো গড়াগড়ি দেয়। আমি দিইনি কিন্তু দুই চোখ বেয়ে অবিরল অশ্রুধারা বয়ে গেছে।
গুরু ক্ষমা করবেন, আপনিও অপরাধ নেবেন না, শহর-ইয়ার, কারণ আপনার অনুভূতি-ভুবন গড়ে তুলেছে আমার গুরুর শতাধিক গান, কিন্তু যদি বলি, রবীন্দ্রসঙ্গীতের সর্বোত্তম সম্মেলনেও আমি কাউকে কাঁদতে দেখিনি, কমড়ো গড়াগড়ির কথা বাদ দাও।
ব্যস্! আমি অন্য আর কোনও তুলনা করব না, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে। ইতোমধ্যে বলে রাখি, রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশ্ববৈভবে অতুলনীয়। যে জর্মন লিডার ইয়োরোপে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত, রবীন্দ্রসঙ্গীত তার চেয়ে অনেক বেশি সূক্ষ্ম, তার বৈচিত্র্য এবং বহুমুখী বিকাশ কাব্যলোকে বল্লোক ছাড়িয়ে চলে গেছে বহু ঊর্ধ্বে।
কিন্তু প্রশ্ন, কীর্তন শুনে বালবৃদ্ধ (আমি যখন প্রথম শুনে দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্নার শব্দ চাপতে চেয়েছিলুম তখন আমার বয়স ষোল) কুমড়ো গড়াগড়ি দেয় কেন? আমি অবশ্যই এখানে আড়াইখানা কীর্তনের রেকর্ড বা বেতারে আধঘণ্টা কীর্তন প্রোগ্রাম শোনার কথা ভাবছিনে– দ্বিতীয়টা তো বহুবিধ যন্ত্রের খচখচানি এবং অংশত সেই কারণে কীর্তনীয়ার অবোধ্য শব্দোচ্চারণ সমস্ত ব্যাপারটাকে সত্যকার কীর্তনের এক হাস্যস্পদ ব্যঙ্গরূপে আধঘণ্টা ধরে মুখ ভ্যাংচায়। আজকের দিনে তাই শতগুণে শ্রেয় নিভৃতে নির্জনে চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাসাদি সশ্রদ্ধ বারবার পঠন–প্রহরের পর প্রহরব্যাপী। সে সময়ে গানগুলো যে সুরবর্জিত হয়ে দীনদরিদ্ররূপে হৃদয়ে প্রবেশ করছে। সেটা আমার দুর্দৈব কিন্তু তবু সেটাকেও নমস্কার– সে-ও লক্ষগুণে শ্রেয়, প্রাগুক্ত ওই অর্ধঘণ্টাব্যাপী নির্মম লাঞ্ছনার চেয়ে। সাহস নেই কলকাতা আকাশবাণীর সূর্যাস্ত থেকে রাত্রি দ্বিপ্রহর অবধি জনতিনেক কীর্তনীয়া– মূল গায়েন উত্তম হওয়া চাই- এনে একটানা, অবিশ্রান্ত সুদ্ধমাত্র কীর্তন শোনাবারঃ
বিরক্ত হয়ো না, শহর-ইয়ার, এ নিয়ে আমার ক্ষোভ কোনও সান্ত্বনা মানে না, তাই তোমাকে বললুম।
আরেকটা কথা। জানো বোধ হয়, পাঁচমেশালি গানের মজলিসে কারও যদি কীর্তন গাইবার প্রোগ্রাম থাকে বেশিক্ষণ না, ধরো আধঘণ্টাটাক–তবে সেটা আসে পুরো প্রোগ্রামের একবারে সর্বশেষে। কেন জানো? এই উটকো কীর্তনটাও যদি মোটামুটি রসের পর্যায়ে উঠে যায় তবে তার পর আর কেউ অন্য কোনও গান জমাতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথও কীর্তন সুরের ম্যাজিক জানতেন– কীর্তনের কথার তো কথাই নেই- তাই তিনি এ যুগে যে গান সর্বপ্রথম রেকর্ডে দিলেন সেটি কীর্তন সুরে।
এ সবই বাহ্য। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, কীর্তনে আছে কী যে শ্রোতা কুমড়ো গড়াগড়ি দেবে?
আছে অবহেলিত, অপমানিত, পদদলিত প্রেম। শ্রীরাধার মুখ দিয়ে সহস্র সহস্র কবি শত শত বৎসর ধরে যা বলিয়েছেন তার সারাংশ দেওয়া কি সহজ, না আমার বাদবাকি জীবনটাতে কুলোবে!
রাধা বেচারী বিবাহিতা কন্যা। ওদিকে কৃষ্ণ অতি শিবয়েস থেকেই করেছেন একাধিক অলৌকিক কর্ম–মিরাকল– বৃন্দাবনের সর্বত্র তার যশ প্রচারিত হয়ে গিয়েছে। বৃন্দাবনে সুন্দরী কুমারী গোপিনীরও অভাব নেই। সেই বালক কৃষ্ণকে ভালোবাসে সর্ব গোপিনী, তাদের মাতা, পিতামহী, বৃন্দাবনের সর্ব নরনারী। যে কোনও কুমারী কৃষ্ণের অনুরাগ পেলে জীবন ধন্য মনে করবে কিন্তু তিনি স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে মুগ্ধ করলেন, আকর্ষণ করলেন, সম্মোহিত করলেন, আত্মহারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্যা করলেন বিবাহিতা শ্রীরাধাকে। একদিকে তার আনন্দ-গরবের অন্ত নেই, অন্যদিকে তার শাশুড়ি-ননদী করে তুলল তার জীবন বিষময়। অলঙ্ঘ্য বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে পাগলিনী শ্রীরাধা ছুটে আসতেন কৃষ্ণের বংশীধ্বনি শোনামাত্রই। শত দুঃখ শত যন্ত্রণার মাঝখানেও শ্রীরাধা আনন্দে আত্মহারা আর হবেই-বা না কেন? শ্রীকৃষ্ণের মতো প্রেমিক এই ভারতবর্ষে জন্মেছে কটি!
তার পর একদিন শ্রীকৃষ্ণ সেই সর্বত্যাগিনী রাধার প্রেম অকাতরে অবহেলা করে– আমি বলি অপমানিত পদদলিত করে চলে গেলেন মথুরা।
শহর-ইয়ার, তুমি মথুরা-বৃন্দাবন দেখেছ?
মোটরে দিল্লি থেকে আগ্রা যাওয়ার সময় দেখেছি। ও দুটো তো খুব কাছাকাছি। দুটোর শেষপ্রান্ত তো প্রায় মিলে গেছে।
ঠিক বলেছ। সেই মথুরা থেকে তিনি একদিনের তরে, এক মিনিটের তরে বৃন্দাবনে আসেননি শ্রীরাধাকে দেখতে। উল্টো বৃন্দাবনের ওই অতি পাশের মথুরায়, বলতে গেলে শ্রীরাধার কানের পাশে তিনি ঢাকঢোল বাজিয়ে করতে লাগলেন একটার পর একটা বিয়ে– রুক্মিণী, সত্যভামা, আরও কে কে আমি ভুলে গিয়েছি, মনে রাখবার কোনও সদিচ্ছাও আমার কোনওকালে হয়নি।