আর সুরের দিক দিয়ে শ্রীরাধার বিহসঙ্গীতের সর্বোত্তম অতুলনীয় বিকাশ ফুটে উঠেছে কীর্তনীয়াদের কণ্ঠে, সুরে।
আমি ঐতিহাসিক নই, তাই বলতে পারব না, কত শত বৎসর ধরে কত হাজার বৈষ্ণব কবি তাদের আপন আপন বিরহবেদনার নিদারুণ অভিজ্ঞতা শ্রীরাধার কণ্ঠে শ্রদ্ধাঞ্জলি স্বরূপ রেখে গেছেন। অর্থাৎ তারা নবীন কাব্য রচনা করে, নতুন নতুন নায়ক-নায়িকা নির্মাণ করে, যেমন মনে করুন, নল-দময়ন্তী কিংবা লায়লি-মজনুন, তাঁদের কণ্ঠ দিয়ে আপন আপন বিরহযন্ত্রণার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেননি। তাবৎ বৈষ্ণব কবিদের বিরহবেদনা শ্রীরাধার বিরহবেদনা, আর যুগ যুগ ধরে শ্রীরাধার কণ্ঠে সঞ্চিত তাবৎ বিরহগাথা সর্ব বৈষ্ণব কবির গৌরব-সম্পদ!
নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে, এমনকি আপন প্রিয়াকে রঙ্গমঞ্চ থেকে নির্বাসিত করে দু জনারই নিষ্ঠুরতম বিরহজ্বালার অভিজ্ঞতা ব্রজসুন্দরীর কণ্ঠে সমর্পণ– এই যে প্রক্রিয়াটি এর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ পরিপূর্ণ সচেতন ছিলেন। আপনার মনে আছে, বোলপুরে পারুল বনে যেতে যেতে এক সকালে আমি একটি কবিতা আবৃত্তি করে আপনাকে শোনাই– কোনও টীকাটিপ্পনী না করে?–
সত্য করে কহ মোরে হে বৈষ্ণব কবি,
কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি,
কোথা তুমি শিখেছিলে এই-প্রেমগান
বিরহ-তাপিত। হেরি কাহার নয়ান
রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে
বিরহ-তাপিত?
অবশ্য আমারও ইচ্ছে করে গুরুকে সবিনয় জিগ্যেস করতে, তার বেলা, যার, বিরহ-তাপিত অশ্রু তাঁকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল, যার মুখ যার আঁখি হতে
–এত প্রেমকথা
রাধিকার চিত্তদীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা
চুরি—-
করেছিলেন তিনিও, তাঁর প্রতি তিনি তাঁর কাব্যে সুবিচার করেছেন তো?
ঠিক ওই একই প্রক্রিয়ায়ই ইয়োরোপের বহু বহু কবি ত্ৰিস্তান আর ইজলদের প্রেমগাথায় আপন আপন নিজস্ব প্রেম, বিরহ, মিলন– অবশ্য মিলন অংশ সর্ব কাব্যেই অতি ক্ষুদ্র অংশ পায়– অকাতরে ঢেলে দিয়েছেন। কিন্তু বাঙলা দেশের বিরাট বৈষ্ণবগাথার তুলনায় তিস্তানগাথা সূচ্যগ্র পরিমাণ।
শহর-ইয়ার এতক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। এবারে শুধল, কই, আমি তো ত্রিস্তান ইজলদে কাহিনীর নাম পর্যন্ত শুনিনি।
বড় বেদনার গাথা। আর ইয়োরোপীয় এজাতীয় যত গাথা আছে তাদের মধ্যে আমি এটাকেই সর্বোচ্চ আসন দিই। আপনি যে শোনেননি সেটাও খুব বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে ইয়োরোপের লোক ক্রমেই এসব গাথার প্রতি উদাসীন হয়ে যাচ্ছে। তাই দেখে ফ্রেঞ্চ একাডেমি– এবং জানেন তো পৃথিবীর আর কোনও একাডেমি এর একশো যোজন কাছে আসতে পারে না– প্রায় চল্লিশ বৎসর পূর্বে তাদেরই এক সদস্যের স্কন্ধে গুরুভারটি দেন তিনি যেন লিস্তান সম্বন্ধে যে কটি ব্যালাড পাওয়া যায় তারই ওপর নির্ভর করে কালোপযোগী একখানা নবীন ত্রিস্তান রচনা করেন। সে বিস্তান আমাকে মুগ্ধ করে, এবং তার বাঙলা অনুবাদ আমি আরম্ভ করি কিন্তু শেষ করতে পারিনি।
মূল কথায় ফিরে আসি। এবং যদি অনুমতি দেন, তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়েই আরম্ভ করি। আপনার খুব খারাপ লাগবে না, কারণ আপনি-আমি দু জনাই মুসলমান; ওদিকে রাধাকৃষ্ণের কাব্যরূপ রসস্বরূপ বাদ দিলে তারা হিন্দুদের বিশেষ করে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের উপাস্য দেব-দেবী এবং শ্রীকৃষ্ণ শুধু বৃন্দাবনের রসরাজ নন, তিনি গীতিকাররূপে বিষ্ণুর অবতার। আমি মানুষ হয়েছি আচারনিষ্ঠ মুসলমান পরিবারে। অথচ যে গানটি আমার আট বৎসর বয়সে মনে অদ্ভুত এক নবীন অনুভূতির সঞ্চার করেছিল সেটি
–দেখা হইল না রে শ্যাম,
আমার এই নতুন বয়সের কালে—
এ বিষয় নিয়ে ব্যক্তিগত অংশটা যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি সারি, যদিও আমার অভিজ্ঞতাটার কিঞ্চিৎ– অতি সামান্য– মূল্যও আছে।
শহর-ইয়ার দৃঢ় অথচ সবিনয় মধুর কন্ঠে বললেন, আপনি দয়া করে কোনও বস্তু বাদ দেবেন না। কীর্তন গান রেকর্ডে, বেতার থেকে আমি শুনেছি কিন্তু ওর গভীরে আমি কখনও প্রবেশ করিনি।
আমি বললুম, তার কারণও আমি জানি। জানতে চাইলে পরে বুঝিয়ে বলব।
হ্যাঁ। আমি পানির দেশের লোক, চতুর্দিকে জল আর জল। সঙ্গে সঙ্গে ভোরে, সন্ধ্যায়, রাত্রি দ্বিপ্রহরের অনেক পরেও ভাটিয়ালি গীত। নিশ্চয়ই প্রথম শুনেছি মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে। সামান্যতম বোধশক্তি হওয়ার পর থেকেই শুনেছি কান পেতে এবং অতি শীঘ্রই সেটা আমার রক্তের সঙ্গে মিশে যায়, যেরকম আমার দেশের দানাপানি আমার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। কিন্তু ওই দেখা হইল না রে শ্যাম-এর আগেকার কোনও গানই আমার মনে নেই।
আমাদের পরিবার আচারনিষ্ঠ, তার ঐতিহ্যে কট্টর প্যুরিটান। গান-বাজনা আমাদের পরিবারে বরাহমাংসবৎ ঘৃণ্য। কিন্তু সে কোন নিয়তি আমাকে ওই গানের দিকে আকৃষ্ট করল জানিনে। আট বছর বয়সে নতুন বয়সের কালে দেখা না হওয়ার ট্র্যাজেডি হৃদয়ঙ্গম করার কথা নয়। তবে আকর্ষণ করল কী? জানিনে, সত্যি জানিনে।
তার পর বহু গান শুনতে শুনতে পরিচিত হলুম রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে। আমাদের দু জনারই প্রিয় গান কেটেছে একেলা বিরহের বেলা-র নূতন ভুবন নূতন দ্যুলোকে যেন অকস্মাৎ আমার মতো দীন অকিঞ্চনজন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রবেশাধিকার পেল। আপনারই মতো যখন আমার হৃদয়ানুভূতি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রসগন্ধবৈভবে নির্মিত হচ্ছে তখন হঠাৎ পরিচয় হল চণ্ডীদাসের সঙ্গে। তার তাবৎ গানের সংকলন ঘণ্টা তিনেকের ভিতর পড়ে শেষ করা যায়। আমার লেগেছিল পূর্ণ একটি বৎসর। ইতোমধ্যে জানতে পারলুম চণ্ডীদাসের জন্মস্থল নানুর আমাদের বোলপুর থেকে মাত্র মাইল আষ্টেক দূরে। এক বন্ধুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে গেলুম সেখানে পয়দল। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, জমিদার অনাদিবাবুর ছোটভাই শোনালেন কীর্তন গান। তিনি আমাকে ফরমাইশ করতে বললে আমি চণ্ডীদাস থেকে বেছে বেছে আমার আদরের গানগুলো পেশ করলুম। মাত্র কয়েক বছর হল শুনলুম, তিনি গত হয়েছেন, তার সদ্গতি হোক!