আমার চিত্তে কৌতুকরসের সঞ্চার হল। বললুম, আমার বয়সটি কি নিতান্তই প্রেমে পড়-পড় তরুণদের বয়স, যে তাদের সঙ্গে আপনার চেয়ে আমার দহরম-মহরম শ-দুই লিটার বেশি! এবং আমি বাস করি মফঃস্বলে!
কী জ্বালা! আপনার যে গণ্ডায় গণ্ডায় চ্যাংড়া চেলা রয়েছে। আর আমার বিশ্বাস পুরুষমানুষ নিজের থেকে নিতান্ত না চাইলে সহজে বুড়ো হয় না। সে কথা থাক, আমার প্রশ্নটার উত্তর দিন।
দেখুন এ প্রশ্নের উত্তর ঠিক ঠিক কেউ দিতে পারে না। সবাই শুধু আপন আপন একটা খসড়া গোছ, একচোখা ধারণা প্রকাশ করতে পারে। আমার ধারণাটা প্রকাশ করার পূর্বে একটি অতি হ্রস্ব ভূমিকা দিই। এক অতিশয় সহৃদয় বাঙালি সমস্ত জীবন জেলের বড়কর্তারূপে কাজ করে পেনশন নেওয়ার পর কী একটা ঘটনা উপলক্ষে বলেন, তার জেলে একবার একজন গুণী পণ্ডিত আসেন যার অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার বিষয় ছিল মনস্তত্ত্ব এবং বিশেষ করে অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব। দেশ-বিদেশের জেলে তিনি তাঁর অধ্যয়ন-রিসার্চ করেন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের নিয়ে এবং তাঁর একটি অতিশয় বিরল গুণ ছিল এই যে, যত হাড়-পাকা, মুখ-চাপা কয়েদিই হোক না কেন, তাঁর বাক্য, তাঁর আচরণ, এককথায় তার ব্যক্তিত্বের সামনে সে তার হৃদয়ের গোপনতম কথা প্রকাশ না করে থাকতে পারত না। মাসখানেক কাজ করার পর তিনি আমাদের এই বাঙালি জেলারটিকে বলেন, ভারতবর্ষের একাধিক জেলে রিসার্চ করার পরও তিনি এযাবৎ একটিমাত্র জাত-ক্রিমিনাল, অর্থাৎ যে নিরুদ্বেগে, বিবেক নামক প্রতিবন্ধকের নুইসেন্স সম্বন্ধে অষ্টপ্রহর সম্পূর্ণ অচেতন থেকে ক্রাইমের পর ক্রাইম করে যায়, জাস্ট ফর ইট ওন সেক– এরকম প্রাণী এদেশে পাননি, তার মানে এদেশে জাত-ক্রিমিনাল নেই। আমারও মনে হয় এদেশে জাত-জিট নেই। সুদ্ধমাত্র ফুলে ফুলে মধু পান করার জন্য একটার পর একটা পুরুষ জিটু করে করে যৌবনটা কাটাচ্ছে এ রকম রমণী এদেশে বোধ হয় বিরল। এই যে আপনি হিন্দু নারীর পতিব্রতা হওয়ার আদর্শের কথা একাধিকবার তুলেছেন, সেই সংস্কারটা এদেশের তরুণীর ভিতর আবির্ভূত হয়– যেই সে প্রথম প্রেমে পড়ে। আর আপনার যে উদাহরণ;- একটি তরুণী দুটো প্রেমিকের সঙ্গে একই সময়ে প্রেম চালিয়ে যাচ্ছে, সেটাও এদেশে হয় অন্য কারণে। আমার মনে হয়, একটু অনুসন্ধান করলেই ধরা পড়বে, বেচারী মনস্থির করতে পারছে না, দুটোর কোনটাকে বিয়ে করলে সে আখেরে সুখী হবে, এবং তাই কোনওটাকেই হাতছাড়া করতে পারছে না।
আপনার প্রশ্নের উত্তর খানিকটে তো দিলুম, কিন্তু আমার প্রশ্ন জিল্টিং নামক অতি প্রাচীন অথচ নিত্যনবীন কর্মটির প্রতি আপনার এ কৌতূহল কেন? আমি নির্ভয়ে, নিঃসন্দেহে দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করতে পারি আপনি কখনই জিল্টিং রহস্যের মর্মস্থলে পৌঁছতে পারবেন না। আপনি হিন্দু হলে বলতুম, এ জন্মে না, জন্ম-জন্মান্তরেও না।
কেন, আমি কি এতই ইডিয়ট?
আমি বললুম, তওবা তওবা!! আপনি ইডিয়ট হতে যাবেন কেন? আপনি অতিশয় বুদ্ধিমতী একথা আমি কেন, আমার গুরুর গুরুও বলবেন। কিন্তু, কল্যাণী, এ তো বুদ্ধি দিয়ে বোঝবার বস্তু নয়। এটা সম্পূর্ণ অনুভূতির ব্যাপার, এবং মনে রাখবেন, আপনি আমাকে অতি উত্তমরূপে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝিয়েছেন আপনার অনুভূতি, আপনার স্পর্শকাতরতা এর সব-কিছু গড়ে উঠেছে, আকার নিয়েছে, আর্দ্রতা পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের ভিতর দিয়ে। এবং সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলেছেন, আপনি আপনার হৃদয়ের খাদ্য আহরণ করেন ওই একমাত্র রবীন্দ্রসংগীত থেকে।
কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতে জিল্টিং নিয়ে গান কই? জিন্টেড় হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা কি কস্মিনকালেও তার হয়েছিল? শুধু প্রভাত মুখো কেন, ঠাকুরবাড়ির প্রাচীনতম বৃদ্ধবৃদ্ধা এবং সে বাড়ির সঙ্গে বাল্যকাল থেকে সংশ্লিষ্ট জন কেউই তো কখনও সামান্যতম ইঙ্গিত দেননি যে রবীন্দ্রনাথ কখনও কাউকে ভালোবেসে জিড়ে হয়েছেন। তার প্রেমের গানের মূল সুর মূল বক্তব্য কী? আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলুম, তুমিও আমাকে বেসেছিলে। তার পর তুমি হঠাৎ অকালে চলে গেলে। তাই
এখন আমার বেলা নাহি আর
বহিব একাকী বিরহের ভার?
কিংবা
তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে
কত আর সেতু বাঁধি।
এটা অবশ্যই তার দুর্ভাগ্য যে, তাঁর প্রিয়া অকালে অন্যলোকে চলে গেলেন। এই দুর্ভাগ্য নিয়েই তিনি রূপ দিয়েছেন শত শত গানে– দু দশ বছর ধরে নয়, সমস্ত জীবন ধরে– কিন্তু মোতিফ এক্ : তুমি চলে গেলে আমি আর কতকাল ধরে তোমার বিরহ-ব্যথা সইব?
শহর-ইয়ার বললে, মাফ করবেন– হঠাৎ আমার মনে একটা প্রশ্ন এল। আমার অনুভূতি আমার ইমোশান যেমন রবীন্দ্রনাথের গান গড়ে দিয়েছে, আপনার ক্ষেত্রেও কি তাই নয়? আপনি তো তাঁকে কাছের থেকে দেখেছেন, তাঁর বহু বহু গান আপনি এবং আপনার সতীর্থরাই সর্বপ্রথম শুনেছেন।
আমি বললুম, গুরু যেন অপরাধ না নেন! আমার অনুভূতি-জগৎ নির্মিত হয়েছে অন্য বস্তু দিয়ে। গুরুর কাছ থেকে সিকি পরিমাণও নিয়েছি কি না সন্দেহ।
শহর-ইয়ার বিস্মিত হয়ে শুধাল, তবে কোথা থেকে?
বৈষ্ণব পদাবলি থেকে।
আপনি নিশ্চয়ই জানেন বাঙলা দেশের সর্বত্রই যে মোতিফ নিয়ে সবচেয়ে বেশি গান গাওয়া হয় সেটি রাধাকৃষ্ণের। এবং আরও পরিষ্কার হয়, আরও সংকীর্ণ পরিসরে সেটা জাজ্বল্যমান হয় যদি বলি আসলে মোতিফটা শ্রীরাধার বিরহ। সেই বিরহের গান গাওয়া হয়, নিত্য নব রচা হয় বাংলা দেশের নানা অঞ্চলে নানা সুরে। কথার দিকে শ্রীরাধার বিরহ-যন্ত্রণার সর্বোত্তম অতুলনীয় প্রকাশ এই আমাদের বীরভূমের চণ্ডীদাসে। এর পরে আসেন বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস ইত্যাদি। মুসলমান কবিও বিস্তর আছেন তবে একমাত্র সৈয়দ মর্তুজা ছাড়া আর কেউই খুব উচ্চস্তরে উঠতে পারেননি– যদিও তাদের সহৃদয়তা, শ্রীরাধার প্রতি তাদের অনুরাগ ও সহানুভূতি হিন্দু কবিদের চেয়ে কণামাত্র কম নয়।