নমো নমো সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গীর তীর, স্নিগ্ধসমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।
তার পর গান ধরল, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান–
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান—
হঠাৎ গান বন্ধ করে বলল, মিস্টার মনসুর কিন্তু লোক খারাপ নয়– কী বলেন আপনি? আসলে কী জানেন, ওঁরা থাকেন এক ভুবনে, আমাদের বাস সম্পূর্ণ অন্য ভুবনে। বিপদ শুধু এই ওঁরা আমাদের কনভার্ট করতে চান।
আমি বললুম, কনভার্ট করাটা কি দোষের? ওইটেই তো মুসলমানদের স্ট্রং পয়েন্ট। কাইরোর অজহর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বিষয় সবাইকে পড়তে হয়। কী করে অমুসলমানকে মুসলমান করা যায়! মনসুর মিশনারির দোষ বিশ্বসুদ্ধ লোককে উর্দুতে কনভার্ট করার চেষ্টাতে গলদ নয়– গলদ তার পদ্ধতিতে, মেথডে, মডুস্ অপেরাভিতে। দম্ভ নিয়ে প্রচার আরম্ভ করলে যাকে কনভার্ট করতে চাও, সে সঙ্গে সঙ্গে ভাববে, আমি যত ভালো উর্দুই শিখি না কেন, এর সঙ্গে তো কখনও কাঁধ মেলাতে পারব না, কারণ উর্দু এঁর মাতৃভাষা। অতএব বাকি জীবন ধরে ওঁর মুখের দম্ভোগীরণ আমাকে সয়েই যেতে হবে। কী দরকার গায়ে পড়ে করুণার পাত্র হওয়ার! তার চেয়ে থাকি আমি আমার বাঙলা নিয়ে। দু পাঁচটা ভুল সে ভাষাতে করলে কীই-বা এমন দুশ্চিন্তা পাড়া-প্রতিবেশীরাও করে। আমরা সবাই বরাবর। ওই উর্দুর গোসাঁইও নিশ্চয় দু পাঁচটা ভুল করেন তাঁর চোস্ত উর্দুতে মানুষ তো আর আল্লা নয় কিন্তু সে ভুল তো আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাব কী করে? কিন্তু এসব নিয়ে এখন আর চিন্তা করেন কেন? এ তো অতি সাধারণ, স্থূল দৈনন্দিন ঘটনা। দেখলেন না, আমি আলোচনায় মোটেই যোগ দিলুম না।
সে তো স্পষ্ট দেখলুম। এবারে বলুন, কাইরোতে ইসলাম-প্রচার-পদ্ধতি সুচারুরূপে শেখার পর কজন অমুসলমানকে মুসলমান করেছেন?
আমি বললুম, প্রথম তো নিজেকেই সামলাই। আমার মতো গুনাহগার পাপী মুসলমান এ সংসারে খুব বেশি নেই। আগে তো একটা মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছই, তবে না প্রচারকার্য আরম্ভ করার হক জন্মাবে।
শহর-ইয়ারের চেহারা দেখে মনে হল আমি যুক্তি দেখিয়ে তাকে আমার সঙ্গে একমত করাতে পারিনি। সো ভি আচ্ছা। শেষবিচারের দিনে তিনি যদি সাক্ষ্য দেন যে আমি খুব খারাপ মুসলমান ছিলুম না– অন্তত আমি নিজের সম্বন্ধে যতটা ভেবেছিলুম তার চেয়ে কম– সে-ও একটা ভরসার কথা।
বললুম, একটু সরে এসে এই গাছটার তলায় ওই শিকড় দুটোর মাঝখানে বসুন। এখানে বসলে তদ্দণ্ডেই মেয়ে মাত্রেরই একটি বিশেষ শক্তিলাভ হয়। নির্ভয়ে নির্বিচারে মিথ্যে কথা বলতে যখন তার আর কোনও বাধাবন্ধ থাকে না। পরের দিন বিকেলে আর একটি ছেলের সঙ্গে তার লীলাখেলার এপয়েন্টমেন্ট– আজ সন্ধ্যায় এখানে বসলে সে অকুণ্ঠ ভাষায় নির্ঘ বিবেক নিয়ে গদগদ হয়ে অন্যজনকে বলতে পারে, আই লাফ ইউ, আই লাফ ইউ।
লাফ কেন, লাভই তো উচ্চারণ। ভাষাটা তো আর জর্মন নয় যে ভি এফ হবে?
এটা সর্বাধুনিক, chic উচ্চারণ।
না। আমার মনে হয় তা নয়। মেয়েটা আই লা এট ইউ, আই লাফ এট ইউ। এট-টা উহ্য রেখেছিল, ভদ্রতার খাতিরে। সঙ্গে সঙ্গে শহর-ইয়ার হেসে ওঠাতে সাদা দাঁতগুলো ঝিলমিল করে উঠল কিন্তু মুখের রঙটি অন্দরমহলের বংশানুক্রমিক ধবলের চূড়ান্তে পৌঁছে গেছে বলে কন্ট্রাস্টটার খোলতাই জুৎসই হল না– মুখের রঙ কালো হলে যেরকম হত।
শহর-ইয়ার মুচকি হেসে হেসে বললে, আচ্ছা, বলুন তো, একটা মেয়ের যদি দু জন প্রেমিক থাকে, এবং সে যদি দু জনকেই পরিতৃপ্ত করতে পারে, তাতে সমাজেরই-বা কী, আর আপনি শিক্ষিত লোক, আপনারই-বা কী মরেল অবজেকশন থাকতে পারে?
আমি বললুম, সমাজের আপত্তি বা আমার মরেল অবজেক্শন এগুলো পরের কথা। আসলে কি জানেন, জিনিসটা ঠিক স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে না। মেয়েটাকে সর্বক্ষণ লুকোচুরি খেলতে হয়, সর্বক্ষণ ভয়, দু জনার একজন কখন না অন্যজনের গন্ধ পেয়ে যায়– বিবাহিতা রমণী উপপতি রাখলে তাকে যেরকম অষ্টপ্রহর আশঙ্কায় আশঙ্কায় কাটাতে হয়। একে তো মেয়েটার স্বাভাবিক সুস্থ জীবন বরবাদ– তদুপরি ব্যাপারটা খুব বেশিদিন গোপন থাকে না, জানাজানি হয়ে যায়। জানাজানি হয়ে যাওয়ার পূর্বেই যদি মেয়েটা এই দোটানার স্ট্রেন সইতে না পেরে একজনকে বিদায় দেয় তখন তার এবং ছেলেটার বন্ধুমহলে সে জি রূপে মশহুর হয়ে যায়, কারণ, তারা তো আর জানে না যে মেয়েটা দুটো ভিন্ন লোকের সঙ্গে একই সময়ে লীলাখেলা চালাচ্ছিল এবং সে স্ট্রেন সইতে না পেরে একজনকে বিদেয় দিয়েছে। আর আসল তত্ত্ব জানাজানি হয়ে গেলে তো আরও চিত্তির। তখন রাস্তা দিয়ে যাবার সময় পাড়ার নটবররা তার গায়ে পড়ে প্রেম নিবেদন করে। ভাবখানা এই, দু জন যখন ছিলই তখন তিনজনেই-বা কী দোষ? আর সর্বশেষে বলি, মেয়েটার পক্ষে ছেলেটাকে বিদায় দেওয়ার জিলটিং কর্মটি কি অতই সহজ! চিন্তা করুন, ছেলেটার মোহ যদি তখনও কেটে না গিয়ে থাকে তবে সে চোখের জল ফেলবে, প্রাচীন দিনের প্রণয় স্মরণ করিয়ে দিয়ে তার শপথ কাড়বে! না জিলটিং কর্মটি শুধু জিলুটেড হতভাগার পক্ষেই অপমানজনক তাই নয়, যে জিলটু করে তার পক্ষেও পীড়াদায়ক!
শহু-ইয়ার বললে, এ যুগের অবিবাহিতা তরুণী যুবতীদের চেয়ে আমার বয়স খুব বেশি নয়, তবু এদের সঙ্গে আমার যোগসূত্র সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। তাই জানতে ইচ্ছে করে এদেশে আমাদের অল্প বয়সে শেখা একনিষ্ঠ প্রেমের আদর্শ কি ধীরে ধীরে কিংবা দ্রুতবেগে জিটিং নামক নয়া মালের জন্য জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে, কিংবা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে?