বিন্দুমাত্র দুঃখ প্রকাশ না করে বললে, আপনার মজি। ভবিষ্যতে তো সুযোগ পাব। আমার ভাবনা কী? কলকাতায় আপনার বাসা কোথা?
আমি অবাক হয়ে বললুম, আমি কি লক্ষপতি? শান্তিনিকেতনের বাসা ঠেলতে গিয়েই আমি লবেজান! বন্ধুর বাসায় উঠব।
সঙ্গে সঙ্গে আসন ত্যাগ করে চলে গেল স্বামীর কাছে। আমিও তনুহর্তেই পা নামিয়ে বাঙ্কে সোজা হয়ে বসলুম। পদ্মাসনব্যুহের দুই হাঁটুতে আমি আর হরগিজ বন্দি হব না।
একটু পরেই ডাক্তার খানকে সঙ্গে নিয়ে এসে আমাকে মাঝখানে বসিয়ে দু জনা দু দিকে বসল। আমি বললুম, ভালো হল আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে। মরার আগে একটা ট্রাঙ্ক কল পাবেন। তখন এসে শেষ ইনজেকশনটি দিয়ে দেবেন।
ডাক্তার বললেন, তওবা, তওবা! আর আমি তো প্র্যাকটিক্যাল ডাক্তারি ক্রমেই ভুলে যাচ্ছি। আমি তো রিসার্চ নিয়ে পড়ে আছি।
বেগম ফিসফিস করে ডাক্তারকে বললেন, আহ! যা কইবার তাই কও না!
ডাক্তার বললেন, যদি ইজাজত দেন তবে একটা আরজ আছে। শুনলুম, কলকাতায় আপনি এক দোস্তের বাড়িতে উঠবেন। তার চেয়ে এবারে আমাদের একটা চান্স্ দিলে আমরা সেটা মেহেরবানি মেনে বড় খুশি হব। আমাদের বাড়িতে প্রচুর জায়গা আছে। যদি হিম্মত দেন তো বলি, আপনার কোনও তকলিফ হবে না।
আমি অনেক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললুম, কিন্তু এ যাত্রায় হবে না, আমারই কপাল মন্দ। আসছে বার নিশ্চয়ই।
বেগম ডাগর চোখ মেলে বললেন, আপনার দোস্ত কি ডাক্তার?
আমি বললুম, ঠিক তার উল্টো। বহুকাল ধরে শয্যাশায়ী।
বেগম বললেন, আমাদের বাড়িতে ওই আরেকটি মাইনর সুবিধে। যা খুশি খান, যত খুশি খান, কিংবা তিন দিন ধরে কিছুই খেলেন না, হিমে সমস্ত রাত ছাতে চক্কর মারুন, যা খুশি করুন ডাক্তার তো হাতের কাছে রয়েছে, ভয় কী?
আমি হেসে বললুম, উনি-না ডাক্তারি বেবাক ভুলে গিয়েছেন!
বেগম বললেন, কী যেন নউজুবিল্লা, বলতে নেই– হাতির দাম লাখ টাকা।
আমি ভালো করে বুঝিয়ে বললুম যে, আমার শয্যাশায়ী বন্ধু আমার জন্য প্রহর গুনছে। তাই সেখানে না গিয়ে উপায় নেই। কিন্তু আসছে বারে অতি অবশ্য, সাত সত্য, তিন কসম ওঁরাই হবেন আমার কলকাতার অন্নদাতা–মেজুমান।
ট্রেন দক্ষিণেশ্বরে থামল বলে বেঁচে গেলুম। আমার এক চেনা এবং দোস্ত, পাশের ভিমকোতে কাজ করে; বোস বলেছিল স্টেশনে আমাকে দেখতে আসবে। লাফ দিয়ে নামলুম প্ল্যাটফর্মে। মজুমদারও বোসকে চেনেন। তিনিও নামলেন।
কই, রাস্কেলটা আসেনি!
মজুমদার বললেন, জানেন আলী সাহেব, মেয়েটি বড়ই সরলা। কিন্তু যে কোনও লোক অতি সহজেই ভুল বুঝে মনে করতে পারে উনি বুঝি পুশিং ফ্লার্ট। এ টাইপ আমি খুব বেশি দেখিনি কিন্তু যা দু একটি দেখেছি সে-ও মুসলমান পরিবারে।
আমি বললুম, আমারও তাই মনে হয়, কিন্তু আপনি এ মীমাংসায় পৌঁছলেন কোন পর্যবেক্ষণের ফলে?
মজুমদার আমাকে ধাক্কা দিয়ে কামরায় তুলে দিয়ে নিজে পিছনে ঢুকলেন। বললেন, পরে হবে।
এবারে কামরাতে সার্বজনীন আলোচনা হল হিন্দুসমাজে যে ডিভোর্স বা লগ্নচ্ছেদ প্রবর্তন হয়েছে তাই নিয়ে। মুসলমানদের ভিতর তো গোড়ার থেকেই আছে; কিন্তু প্রশ্ন তার সুবিধে নেয় বাঙলা দেশের কী পরিমাণ মুসলমান নরনারী? অল্পই। তবে হিন্দুদের বেলা? আলোচনাটা জমল ভালো, কারণ ডাক্তার আর আমি, হিন্দুদের অজানা, মুসলমানদের পারিবারিক ভিত্তি সম্বন্ধে তথ্য সাপ্লাই করলুম, আর হিন্দুরা তাই নিয়ে স্পেকুলেট করলেন।
বেগম সাহেব মুখ খুললেন না। তবে ওস্তাদের মার শেষ রাতে। ট্রেন যখন শেয়ালদা পৌঁছল তখন তিনি মোক্ষম বাণ ছাড়লেন, হিন্দুদের মেয়ে-স্কুলে এখনও স্ট্যান্ডার্ড টেক্সট বুক ভূদেববাবুর পারিবারিক প্রবন্ধ। আমার বান্ধবীর মেয়েকে দিন সাতেক আগেও পড়িয়েছি।
.
০২.
হিন্দুরা বলে মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক। বোধ হয় কথাটা সত্য, নইলে শহর-ইয়ার আমার ক্যালিবারের লেখককে নিয়ে অতখানি মাতামাতি করবে কেন? এদেশে তো আর গণ্ডায় গণ্ডায় মুসলমান লেখক নেই, কাজেই আলী, আলীই সই। কথায় আছে, বিপদে পড়লে শয়তান তক্ মাছি ধরে ধরে খায়।
উপস্থিত অবশ্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মাছিই শয়তান খাবে। কথাবার্তায় তো মনে হল ডাক্তার পরিবার কলকাতার খানদানিদের একটি। অতএব নিশ্চয়ই উত্তম মোগলাই খানাপিনার অনটন হবে না। সুভাষিতের একটি দোহা সামান্য ট্যারচা করলে অর্থ দাঁড়ায় পণ্ডিতদের সবই গুণ; দোষের মধ্যে এই যে, ব্যাটারা বড় মূর্খ। হিন্দুদের বেলাও তাই। ওদের অনেক গুণ; দোষের মধ্যে এই যে, তারা মাংস রাঁধতে জানে না। সেটা মেরামত করার জন্য সমস্ত জীবন ধরে জীবনটা তো ওদের সঙ্গেই কাটালুম চেষ্টা দিয়েছি। মাতাল যেমন গাঁটের পয়সা খর্চা করে অন্যকে মদ খেতে শেখায়, পরে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে নেশাটি করবে বলে, আমিও তেমনি বিস্তর হিন্দুকে গায়ে পড়ে মোগলাই শেখাবার চেষ্টা করেছি, অর্থাৎ ফাঁকি দিয়ে শটকে শেখাবার মেহন্নত বরদাস্ত করেছি, পরে তারই মেওয়াটি খাব বলে, কিন্তু হলে কী হয়, ওই যে মুসলমানরা বলে হিন্দুরা বড় সঙ্কীর্ণচেতা, আপন ধর্মের গণ্ডির ভিতর কাউকে ভাই-ব্রাদার বলে নিতে চায় না, রান্নার বেলা অন্তত নিশ্চয়ই তাই। তা সে যাকগে, এখন যখন শহর-ইয়ার গঙ্গোদক জুটে গেছে তখন কূপোদকের কী প্রয়োজন।