যেন গৌরীশঙ্করের চুড়ো থেকে গুরুগম্ভীর ঐশী বাণী নেমে এল :
না, বাঙলা শেখার কোনও জরুরত আমার ছিল না।
শহর-ইয়ার হঠাৎ কীরকম যেন বদলে গিয়ে একেবারে ভিন্ন কণ্ঠে বলল, সে তো ঠিকই করেছেন। এদেশে কত ইংরেজ বওলা দশ-বিশ বছর কাটিয়ে যায়, এক বর্ণ বাঙলা না শিখে। আপনারই-বা কী জরুরত।
বকসওলা কথাটা আমি স্বরাজলাভের পর আদৌ শুনিনি। ইংরেজ চাকুরে সিভিলিয়ান মবরা চা-বাগিচার অশিক্ষিত– এমনকি বর্বর বললেও অত্যুক্তি হয় না– সায়েবদের এই পিসূচক নাম দিয়েছিল চায়ের পেটি বা বক্স নিয়ে তাদের কারবার করতে হয় বলে। মনসুর সাহেব হয়তো কথাটা পূর্বে কখনও শোনেননি তাই অর্থটা ধরতে পারেননি। জিগ্যেস করলেন, বকসওলা কী?
শহর-ইয়ার যেন প্রশ্নটা শুনতেই পায়নি এরকম ভাব করে মিসিস মনসুরের দিকে কুঁকে দরদভরা কণ্ঠে কী যেন শুধাল।
তর্ক থেমে গেছে কিন্তু তবু মনসুর থামতে চান না। তিনি উর্দু সাহিত্যের ঐশ্বর্য ও প্রসাদগুণ সম্বন্ধে দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে চললেন। তার অধিকাংশই খাঁটি সত্য কথা, কিন্তু বলার ভঙ্গিতে ভঙ্গিতে কেমন যেন একটা কর্কশ কর্কশ ইঙ্গিত, তোমার বাঙলায় এরকম আছে? ওই গোছ। কিন্তু শহর-ইয়ার সেই যে মুখ বন্ধ করেছিল আর একবারের তরেও খুলল না। এই অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইরানিরা বলেন, তখন আলোচনার কার্পেট রোল করে তুলে নিয়ে খাড়া করে একপাশে রেখে দেওয়া হল। উপস্থিত তারও বাড়া কিছু যেন চোখের সামনে দেখতে পেলুম। যেই শহর-ইয়ার সামান্যতম আভাস পেল যে দ্রব্যগুণেই হোক আর যে কোনও কারণেই হোক, মনসুর আবার সেই কার্পেটটা গড়গড়িয়ে খুলতে চান, ধুরন্ধরী সঙ্গে সঙ্গে এক লম্ফে যেন টাইট হয়ে গিয়ে বসল সেই রোল করা কার্পেটটার উপর।
আল্লায় মালুম, মনসুর সাহেবের লেকচার কখন শেষ হবে। আমার প্রিয় বান্ধব ডাক্তার সাহেব আবার কারও কথা মাঝখানে কেটে দিয়ে আপন কথা বলতে একেবারেই অসমর্থ। ওদিকে আমি যেন আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে একটা দুর্গন্ধ পেলুম যে ডাক্তারের ইচ্ছে আমাদের সকলকে বাইরে কোনও মোগলাই রেস্তোরাঁতে খাওয়াতে চান এবং এখানে আসবার সময় সেটা বলতে ভুলে গেছেন। সর্বনাশ! তা হলেই হয়েছে! কী করি, কী করি! মনে পড়ল, স্কুলের পণ্ডিতমশাই আমাকে একদিন বলেছিলেন, সাহিত্যিক হতে হলে যে কটি গুণের প্রয়োজন, যেমন ভাষার ওপর দখল, কল্পনাশক্তি এবং আরও বহুবিধ কলাকৌশল তার মাত্র একটি তোর আছে- নির্জলা মিথ্যে বলার নির্লজ্জ চতুরতা। জয় গুরু, জয় গুরু! তোমার মহিমা অপার। তোমাকে স্মরণ করা মাত্রই অজ্ঞান-তিমির-অন্ধকার দূরীভূত হয়ে গেল : সম্মুখে দেখি দিব্য জ্যোতি, সত্য জ্যোতি।
যেই মনসুর সাহেব দিতে গেছেন গেলাসে আরেকটি চুমুক অমনি আমি সবাইকে না শুনিয়ে আবার শুনিয়েও শহর-ইয়ারকে বললুম, আমি তা হলে উঠি। আপনি বাবুর্চিকে বলে এসেছেন তো কীভাবে আমার পথ্যিটা তৈরি করবে? তার পর লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে মনসুর সাহেবকে বললুম, আপনার বন্ধু ডাক্তার সাহেবের আপন হাতের চিকিৎসার জন্যই আমার মফঃস্বল থেকে শহরে আসা। পাছে অপথ্য-কুপথ্য করি তাই আমাকে প্রায় তালাবন্ধ করে রেখেছেন আপন বাড়িতে, হেঁ হেঁ হেঁ। আপনার সঙ্গে আবার পরিচয় হওয়ায় বড় আনন্দ হল, হেঁ হেঁ। ডাক্তার গোবেচারা ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকাল। শহর-ইয়ার আমার কথা শেষ হওয়ার বহু পূর্বেই আমার মতলবটা ভালো করেই বুঝে নিয়েছে– আমি নিঃসন্দেহ, সে-ও এখান থেকে পালাবার পথ খুঁজছিল, কিন্তু বেচারী মেয়েছেলে হয়েও না পারে অশিক্ষিত পটুত্বের অভিনয় করতে, না পারে নির্জলা মিছে কথা কইতে। এবারে আমি একটা পথ করে দেওয়া মাত্রই সে চেয়ার ছেড়ে এমনভাবে ঘাড় নাড়াল যে তার থেকে এ-ও হয় ও-ও হয়। ডাক্তার বিশেষ মনঃক্ষুণ্ণ হলেন বলে মনে হল না– কারও কোনও ইচ্ছাতে বাধা দেওয়া তার ধাতেই নেই। এরকম মহামানব সংসারে বড়ই বিরল।
বিস্তর শেকহ্যান্ড, খুদা হাফিজ, ফি আমানিল্লাহ, বঁ ভওয়াইয়াজ বলার পর শহর-ইয়ার শুধু মনসুর সাহেবকে দুটি অনুরোধ জানাল, আসছেবার কলকাতায় এলে যেন তাদের ওখানে ওঠেন এবং আজ রাত্রের মতো যেন ডাক্তারকে একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেন। মাদাম মনসুরকে শহর-ইয়ার এ অনুরোধ আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন।
ঘর থেকে বেরিয়ে করিডরে পৌঁছনো মাত্রই শহর-ইয়ার গান ধরল, আর বেশ উচ্চকণ্ঠেই, অবশ্য এসময় কেউ যদি আদপেই কাছে-পিঠে থাকে তবে সে সে-ব্লকের বেয়ারা–
হাটের ধুলা সয় না যে আর, কাতর করে প্রাণ।
তোমার সুরসুরধুনীর ধারায় করাও আমায় স্নান।
.
০৮.
ড্রাইভার শুধালে, কোথায় যাব, আম্মা?
শহর-ইয়ার ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে বললে, বেহেশত কিংবা দোজখৃ– যেটা এ জায়গা থেকে বেশি দূরে।
বেচারী ড্রাইভার বুঝতে পারেনি। আমি বললুম, উপস্থিত গঙ্গা-পারে চল। পরে দেখা যাবে।
একটা জায়গায় ভিড় সামান্য কম। আমি বললুম, শহর-ইয়ার, এখানে ওই গাছতলায় একটু বসবেন?
বললে, নিশ্চয়ই বসব, একটুখানি তাজা হাওয়া বুকের ভিতর ভরে নিই। গ্রেট ইস্টার্ন তবু পদে আছে, অন্য হোটেলগুলোতে যেন আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। গঙ্গার হাওয়া গঙ্গাজলের চেয়ে ঢের ভালো। তাই হিন্দুরা গঙ্গাস্নানের পরিবর্তে এখন গঙ্গার হাওয়া খেয়ে পাপমুক্ত হয়। এ হাওয়ার বহু গুণ। সঙ্গে সঙ্গে প্রথম আবৃত্তি করল,