বিস্ময়ে আমি হতচৈতন্য! ঠাকুর্দার নাম স্মরণ করতে পারছিনে!
কিন্তু মোক্ষম তাজ্জব মেনেছেন মৌলানা মনসুর।
বাজারে যতখানি গাম্ভীর্য সেদিন বেচা হচ্ছিল তার সাকুল্যে স্টক কিনে, সর্ব মুখে মেখে বললেন, উর্দু ভাষা ও সাহিত্য এদেশে ইসলামের প্রতিভূ!
শহর-ইয়ার বিস্ময় প্রকাশ করে বললে, তাই নাকি? তা হলে বিবেচনা করি, প্রত্যেক মুসলিমের যেটা প্রথম কর্তব্য অর্থাৎ ইসলাম-ধর্ম-তত্ত্ব-শিক্ষা, সে সম্বন্ধে কি উর্দুতে ভূরি ভূরি কেতাবপত্র রয়েছে? কিন্তু আমি তো শুনেছি অবশ্য আমার সংবাদদাতা ভুল করে থাকতে পারেন আপনারা কুরান শরিফের উর্দু অনুবাদ ছাপিয়েছেন মাত্র পঞ্চাশ-ষাট বৎসর পূর্বে। তারও ত্রিশ বৎসর পূর্বে হিন্দু গিরিশবাবু বাঙলাতে কুরান অনুবাদ ছাপিয়েছিলেন।
তার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই মনসুর বললেন, আরবির সঙ্গে উর্দুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
আমি জানি শহর-ইয়ার আগের পয়েন্টে আরও অনেক-কিছু বলতে পারতেন, কিন্তু প্রতিপক্ষ যখন ভিন্ন রণাঙ্গনে চলে গেলেন তখন শহু-ইয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উপস্থিত। বললেন, সে আবার কী করে হল? আরবি ভাষা হিব্রুর মতো সেমেটিক; উর্দু ভাষা বাঙলারই মতো আর্য-গোষ্ঠীর ভাষা। সম্বন্ধটা নিবিড়তর হল কী করে?
মনসুরের মুখ ক্রমেই লাল হতে আরও লাল হচ্ছে। ডাক্তার নীরব, কিন্তু ঈষৎ অপ্রতিভ। মাদাম মনসুর পানপ্রসাদাৎ ইতোমধ্যেই ঈষৎ বে-এখতেয়ার। আমি চুপ। কারণ শহর-ইয়ার তার তলওয়ার চালাচ্ছে পাকা ওস্তাদের মতো। তার মুখে রত্তিভর উত্তেজনা নেই।
মনসুর বললেন, উর্দু তার শব্দসম্পদ আহরণ করে আরবি থেকে।
শহর-ইয়ার বললেন, So what? উর্দু কেন, বাঙলার তুলনায়ও ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়ের ভাষা নিয়েছে অতি সামান্য পরিমাণ আরবি শব্দ এবং এগুলো যে আরবির মতো সেমেটিক গোষ্ঠীর ভাষা নয় সে-ও তো জানা কথা। কিন্তু ইন্দোনেশিয়েরা যেরকম ইসলামি ঝাণ্ডা খাড়া করেছে, পেরেছে সেরকম এদেশের উর্দুওলারা? আমি তো শুনতে পাই, দিল্লি-আগ্রা-লক্ষ্ণৌ-এলাহাবাদের স্কুলে স্কুলে উর্দু সরিয়ে হিন্দি শেখানো হচ্ছে। উর্দুওলারা কী লড়াই দিচ্ছেন তার বিরুদ্ধেঃ আকাশবাণী স্বরাজের পর থেকে আর উর্দুতে নিউজ বুলেটিন দেয় না, শুনছি শিগগিরই দেবে। তবে সেটা পণ্ডিতজির চাপে। আপনাদের আন্দোলনের ফলে নয়।
মনসুর ফেটে যাওয়ার উপক্রম। বললেন, আমরা পাকিস্তান নির্মাণ করেছি।
এই প্রথম শহর-ইয়ারের কণ্ঠে ঈষৎ ব্যঙ্গের পরশ লাগল। বললে, তাই নাকি? আমি তো শুনেছি বাঙলার মুসলমান যাদের অধিকাংশ এখন পূর্ব পাকিস্তানে বাস করে, এবং সংখ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে বেশি তাদেরই ক্রেডিট বেশি। তা উর্দু যদি এতই ইসলামি ভাষা হবে তবে পূর্ব পাকিস্তানিরা উর্দুকে তাদের অঞ্চলে রাষ্ট্রভাষা করছে না কেন? শুনেছি, তাদের মাতৃভাষা বাঙলার জন্য লড়তে গিয়ে কেউ কেউ প্রাণ দেওয়াতে শহিদরূপে আজও পরিচিত হচ্ছে। আর পশ্চিম পাকিস্তানেই-বা উর্দু কোথায়? সিন্ধিরা বলে সিন্ধি ভাষা, বেলুচরা বেলুচি, পাঠানরা পশতু রইল বাকি পাঞ্জাব। তারা তো বলে পাঞ্জাবি, শেখে উর্দু। কিন্তু ইতোমধ্যেই তো সেখানে আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছে, পাঞ্জাবি কথ্যভাষা, শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যম করার জন্য সেটাকে লিখিত রূপ দিয়ে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার ইজ্জত দেওয়া। এ জাতীয় সম্মান পাঞ্জাবি কথ্যভাষা তো আগেও পেয়েছে। গুরু নানকের গ্রন্থসাহেব তো পাঞ্জাবি কথ্যভাষায় রচিত। কিন্তু এসব বিবরণ থাক্– আমি পশ্চিম পাকিস্তান সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নই। কিন্তু এ সম্পর্কে আমার একটি শেষ নিবেদন আছে। আপনি বললেন, আপনারা, অর্থাৎ উর্দুভাষীরা পাকিস্তান নির্মাণ করেছেন। উত্তম প্রস্তাব। আজকের দিনের পাকিস্তানিরা যে কায়েদ-ই-আজম মরহুম মুহম্মদ আলি জিন্নাহ সাহেবকে তাদের জাতির পিতা বলে সর্বোচ্চ সম্মান দেয়, তার মাতৃভাষা কি উর্দু ছিল?
মনসুর চুপ করে রইলেন। তর্ক যে আরও চালাতে পারতেন না তা নয়। কারণ যুক্তির অভাবই যদি তর্কের সমাপ্তি ঘটাবার কারণ হত, তবে পৃথিবীর শতকরা নিরানব্বই ভাগ এই মুহূর্তেই মুখ বন্ধ করে গোরের নীরবতার আশ্রয় নিত।
ডাক্তার কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় মনসুর বললেন, বাঙলা হিন্দু ভাষা– তার প্রভাব বাঙালি মুসলমানকে হিন্দু-মনোবৃত্তির দাস করে দেয়।
দাস কথাটা বোধ হয় শহর-ইয়ারকে বলদের সামনে লাল পতাকা দেখানোর মতো হল। স্পষ্ট দেখলুম, তার মুখে সামান্যতম কাঠিন্য দেখা গেল। তার পরিমাণ এতই সামান্য যে শুধু আমিই সেটা লক্ষ করলুম। কারণ এতদিন ধরে তাঁর নয়নে-বদনে বহু ভাবের খেলা আমি দেখেছি। বেশিরভাগ সময় তাঁর মুখ শান্ত। দ্র পরিবারের বধূর মতো। কিন্তু সামান্যতম রসের সন্ধান পেলেই মুচকি হাসে কিংবা খলখলিয়ে। বিষণ্ণ, চিন্তিত, বিল আরও বহু ভাবের খেলা তার চোখেমুখে আমি দেখেছি, কিন্তু ওই ভদ্রবধূর শান্তিমাখা মুখে সবচেয়ে বেশি দেখেছি তার রহস্য-ভরা আঁখি। কঠিনতা কখনও দেখিনি।
বলল, বাঙলার শ্রেষ্ঠ ধর্মসঙ্গীত টেগোরের। সেগুলোতে হনুমানজি, রামচন্দ্রজি কেউ নেই। আছেন যিনি, তিনি সুফিদের অল-লক, অল-জমিল– টুথ অ্যান্ড বিউটি। আপনি যখন এদেশে বাঙালি হোস্টেলে বাঙালি-মুসলমানদের ভিতর তিন বছর বাস করে বিস্তর বাঙলা শুনেছেন, তখন আশা করতে পারি এসব টেগোর-সং-এর কিছু কিছু সে যুগে আপনার কানে পৌঁছেছিল এবং তার কিঞ্চিৎ রসগ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন– বাঙালি বন্ধুবান্ধবদের শুধিয়ে অন্তত মোটামুটি অর্থটা জেনে নিয়েছিলেন।