হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় একবার সামান্য একটু মোকা পেয়ে শহর-ইয়ার ফিসফিস করে আমাকে বলেছিল, আপনার জন্যই আজ আমার এই লাঞ্ছনা। এরা ভাববে আমি মারোয়াড়িদের মতো আমার গয়নার দেমাক করতে এসেছি। আমি বললুম, কিন্তু ডাক্তার তো আপনার এই অ্যাকসিডেন্টাল গয়না পরা দেখে খুশি হয়েছেন। তাঁর বন্ধুর কাছে বউকে তো আর বিধবার বেশে নিয়ে যেতে পারেন না।
আমরা কেউ ড্রিঙ্ক করি না শুনে মহফিলের পয়লা রাগিণীটিই সামান্য কমসুরা হয়ে শুরু হল। দিল্লি নগরীর মনসুর মুহম্মদ সাহেব বিড়বিড় করে যা বললেন তার মোটামুটি অর্থ, বিংশ শতাব্দীর সঙ্গে মানিয়ে চলতে হলে তেরোশো বছরের প্রাচীন বিধি-বিধান একটু-আধটু, এদিক-ওদিক উনিশ-বিশ করতে হয়। বেগম মনসুর এক ঢোঁক শেরি গিলে মাথা নেড়ে সায় দিলেন। ডাক্তার তেরোশো বছরের পুরনো কায়দায় এখনও নামাজ পড়েন, উপোস করেন; তবু তিনি কোনও আপত্তি জানালেন না। ওদিকে এ বাবদে উদাসীন শহর-ইয়ারের মুখ দেখি লাল হয়ে উঠেছে।
তার পর বিশেষ কোনও সূত্র ধরে বাক্যালাপ এগোলো না। আমরা যাকে বলি আশকথা পাশকথা। কথার ফাঁকে ফাঁকে মালুম হল, মনসুর সাহেব একদা এই কলকাতার কারমাইকেল হস্টেলে বাসা বেঁধে বছর দুত্তিন পড়াশুনা করেছিলেন এবং সে সময়ে ডাক্তারের সঙ্গে দোস্তি হয়। আমার তাই মনে হচ্ছিল, শ্রেষ্ঠতম ব্যবস্থা হত যদি দুই ইয়ারে দোকলা-দোকলি বসে দুহঁ দুহু কুহু কুহু করতেন– শহর-ইয়ার আর আমার তো কথাই নেই। মাদাম মনসুর পর্যন্ত দ্য এ–ওয়ান টু মেনি। অর্থাৎ সাকুল্যে থ্রি টু মেনি।
মনসুর এবং তার বিবি মাঝে-মধ্যে যে দু একটি ইংরেজি কথা কইলেন সেগুলো শুদ্ধ এবং ভালো উচ্চারণে, অথচ কেন যে তারা অধিকাংশ সময়ই উর্দু চালিয়ে যেতে লাগলেন সেটা বুঝতে পারলুম না। ওঁরা তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন ডাক্তারের যা উর্দু জ্ঞান সেটা দিয়ে বহুৎ ব-তকলি ব-মুশকিল কাজ চালানো যায় কি না-যায় সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে, আমার ভাঙাচোরা উর্দু আমি সভাস্থলে পেশ না করে, যে কটি বাক্য বলেছি সে সবই ইংরেজিতে এবং শহর-ইয়ার যে উর্দুর প্রতি পরিপূর্ণ ঔদাসীন্য দেখিয়ে এ পর্যন্ত তার জীবন কাটিয়ে দিয়েছে সেটা আমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলুম তার সঙ্গে বোলপুর থেকে কলকাতা একসঙ্গে আসার সময়। কি মুটে, কি চা-ওলা, কি রেস্তোরাঁ-বয় কারও সঙ্গে সে ভুলেও বিশুদ্ধ বাঙলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষার সাহায্য নেবার প্রয়োজন বোধ করেনি। এস্থলেও সে ব্যত্যয় করেনি তবে বাঙলা না বলে বলেছে ইংরেজি অবশ্য মুখ খুলেছে সামান্য দু একবার মাত্র। এসব দেখেশুনেও দেব-দেবী দু জনা যে উর্দু কপচাচ্ছিলেন তার থেকে যে কোনও লোকের মনে সন্দেহ জাগা নিতান্ত খামখেয়ালি নয় যে, এঁরা যেন একান্তই উর্দু আনজুমনের মিশনারিরূপে এই বর্বর বাঙলা দেশে বিসুর্দ উর্দু ফলাতে এসেছেন!
এ অভিজ্ঞতা আমার একাধিকবার ইতোপূর্বেও হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ তথা দিল্লিবাসিন্দা কলকাতার মুসলমানদের মাঝখানে বসে উর্দু তড়পাবার সময় ভাবখানা করেন যে ওনারাই একমাত্র খানদানি মনিষি, খাস বেহেশতে জিব্রাইল গয়রহ দেবদূতরা উর্দুতেই বাৎচিৎ করেন– অবশ্য তারা সকলেই বাল্যকালে মনুষ্যরূপ ধারণ করে নিদেন বছর দশ দিল্লি-লক্ষ্ণৌয়ে উর্দুটা রপ্ত করে যান। উত্তরপ্রদেশ-দিল্লির উর্দুওলাদের এই হ-বড়াইর জন্য অবশ্য বেশকিছুটা দায়ী কলকাতার মুসলমানই। সে-বেচারী হিন্দু-প্রধান কলকাতায় যেখানে উর্দুসহ আগত মুসলমান কল্কে পায় না– তার জাতভাইকে যতখানি পারে সৌজন্য দেখাতে চায় এবং তার চেয়েও বড় কথা, তার মনের কোণে আছে উর্দুর প্রতি একটা সপ্রশংস মোহ। কিন্তু তার অর্থ অবশ্য নিশ্চয়ই এ নয় যে, সে তার মাইকেল-কবি-কাজী নিয়ে গর্ব অনুভব করে না। সে রকম কোনও বাগ-বিতণ্ডা উপস্থিত হলে সে ওঁদের জন্য জোর লড়াই দেয়। তবে লক্ষ করেছি, উর্দুওলারা এরকম তর্কযুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে চান না; তাঁদের ভিতর যারা চালাক তারা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, বরঞ্চ কলকাত্তাই মুসলমান কিছু কিছু গালিব-ইব্রাল পড়েছে, এরা টেগোরের নাম শুনেছেন– বাদবাকি ব্লাঙ্কো।
দুর্ভাগ্যক্রমে ডাক্তারের বন্ধু তাঁর উর্দুর ঝাণ্ডা ব্যোমলোকের এমনই উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে হয়েস্ট করতে লাগলেন যে, আমার তো ভয় হল ওটা না এভারেস্টের চুড়ো ছাড়িয়ে বেহেশতের লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড দফতরে গিয়ে পৌঁছয়। ডাক্তার নিরীহ মানুষ–হুঁ করে যাচ্ছিলেন সঙ্গে সঙ্গে। শহর-ইয়ারের মুখে কোনও পরিবর্তন লক্ষ করলুম না। আর আমি যে অনারোগ্য, গোরস্তানগমনোৎসাহী কঠিন ব্যাধিতে কাতর তারই নিষ্পেষণে নিশ্চুপ– সে ব্যামোর নাম সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্স। আমি আমার মাতৃভাষা নিয়ে এমনই শশব্যস্ত যে অন্য ভাষা তার চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের কি না সে চিন্তা আমার পুরু নিরেট খুলিটা ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকতে পারে না।
কথায় কথায় মনসুর সাহেব বললেন, উর্দুর প্রচার ও প্রসারের জন্য কলকাতা মাদ্রাসার ব্যাপকতর ব্যবস্থা করা উচিত যাতে করে তাবৎ কলকাতার মুসলমান ছেলেমেয়ে সেখানে গিয়ে উর্দু শিখতে পারে।
আশ্চর্য! এতক্ষণ যে শহর-ইয়ার বিলকুল চুপসে বসে আড়াই ফোঁটা নিন্ধু-পানি চোষাতে সবচৈতন্য নিয়োজিত করে সময় কাটাচ্ছিল সে হঠাৎ বলে বসল, কলকাতা মাদ্রাসা ইসলাম ধর্মশাস্ত্রের চর্চা করে; কুরান, হদিস, ফিকাহ এবং তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি। সেগুলো এ টু জেড আরবিতে। তাই সেখানে আরবি ভাষা শেখানো হয় এবং নিতান্তই যখন সাহিত্যও ব্যতিরেকে ভাষা শেখানো যায় না তাই কিছুটা আরবি সাহিত্যও শেখায়। ফারসি শেখায় অতিশয় নগণ্য পরিমাণে এবং গভীর অনিচ্ছায় তার কারণ ফারসি সাতশো বছর ধরে এদেশের রাষ্ট্রভাষা ও বিদগ্ধ জনের ভাষা ছিল বলে সেটা চট করে ঝেড়ে ফেলা যায় না। যেসব কাচ্চাবাচ্চাদের মাতৃভাষা উর্দু, তাদের হয়তো যৎসামান্য উর্দুও শেখায়। কিন্তু মাদ্রাসার একমাত্র ও সর্বপ্রধান কর্ম হচ্ছে ইসলামশাস্ত্র চর্চা, ইসলামিক থিয়োলজি। সে হঠাৎ ব্যাপকভাবে– এবং নিতান্ত মিনিমাম প্রয়োজনের বাড়া যে কোনওভাবে উর্দু পড়াবার ব্যবস্থা করবে কেন?