হঠাৎ গলা নামিয়ে ঘরোয়া সুরে বললুম, জানেন, শহর-ইয়ার, তাই আমার তাজ্জব লাগে যখন দেখি আমাদের মেয়েরা কি হিন্দু কি মুসলমান বাড়িতে ত্যানা পরে মেলছের মতো স্বামীর চোখের সামনে আনাগোনা করছে, আর যত পাউডার যত অলঙ্কার বাড়ি থেকে বেরোবার সময়! যেন ওই হতভাগা স্বামীটাই এসেছে বানের জলে ভেসে।
শহর-ইয়ার চিন্তিত হয়ে শুধালেন, আমি কি বাড়িতে সত্যি মেলছের মতো থাকি।
আমি হেসে বললুম, আদপেই না। আপনি জেনে-না-জেনে সৌন্দর্যের এতই কদর দেন যে আপনার পক্ষে অসুন্দর বেশ পরা অসম্ভব, অসুন্দর আচরণ অসম্ভব, অসুন্দর
ব্যস, ব্যস, হয়েছে। কিন্তু বাড়িতে সাজতেগুজতে কীরকম যেন শরম শরম লাগে। লোকে কী ভাববে?
আমি প্রায় হুঙ্কার দিয়ে বললুম, আমার যত রাগ তো ঠিক ওইখানেই। লোক বলতে আপনি কাদের মিন করছেন? চাকর-বাকর এবং যে দু একটা উটকো লোক যারা বিন-নোটিশে কাজে-অকাজে বাড়িতে আসে। আমার প্রশ্ন, আপনি তাদের বিয়ে করেছেন, না ডাক্তারকে? তারা কী ভাবল, আপসে কী বলাবলি করল তাতে কী যায়-আসে? আচ্ছা, এখন তবে এ আলোচনা আজ থাক। আমরা মোকামে পৌঁছে গিয়েছি? আপনি ড্রাইভারকে বলুন না, সে যেন ডাক্তারকে গিয়ে বলে আমি গাড়িতে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছি। ড্রাইভার চলে গেলে বললুম, এইবারে দেখি, আমার সোনার চাঁদটি কী করেন। শহর-ইয়ার, আমিও একদা রিসার্চ করেছি এবং কেউ এসে এভাবে উৎপাত করলে বড়ই বিরক্ত হয়েছি। কিন্তু আমার আপনার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, সেটা পাঁচ-সাত মিনিটের ভিতরই অন্তর্ধান করে। বিশেষ করে যারা ডিস্টার্ব করল তারা যদি তার আপনজন হয়– যাদের সঙ্গলাভে সে আনন্দ পায়। দু পাঁচ মিনিট তাদের সঙ্গে কথা বলতে না বলতেই রিসার্চের ভানুমতী কেটে যায়।
জোর পাঁচ মিনিট, দেখি ডাক্তার টাটু ঘোড়ার মতো ছুটে আসছেন। শহর-ইয়ারকে দেখে সামান্য বিস্মিত হলেন বটে কিন্তু তাঁর নিজের ভিতরকার কী এক উত্তেজনা সব-কিছু ছাপিয়ে যেন উপচে পড়ছে। মেশিনগানের চাইতেও দ্রুততর বেগে আমাকে বলে যেতে লাগলেন, ওঃ! আমার কিস্মটা আজ সত্যই বড় ভালো, বড়ই ভালো। এই দশ মিনিট আগে আমি আপনাদের ফোন করে পেলুম না। মহা বিপদে পড়লুম, করি কী? হয়েছে কী জানেন, আমার এক ভেরি ডিয়ার ফ্রেন্ড বউকে নিয়ে দিল্লি থেকে এসেছে। কাল ভোরের প্লেনে ফের দিল্লি চলে যাবে। আপনাকে সে চেনে, দিল্লিতে আপনার লেকচার শুনেছে, দু একবার আপনার সঙ্গে সামান্য কথাবার্তাও বলেছে। আপনার গ্রেট এডমায়ারার। আর তার বউ যখন এসেছে তখন শহর-ইয়ারকে নিয়ে যেতে হয়, নইলে বড় অভদ্রত হয়। দিল্লির খানদানি ঘরের ছেলে– ভাববে কলকাত্তার লোক তমিজ-তহজিব কিছুই জানে না। আপনারা এসে আমায় বাঁচালেন। চলুন, চলুন, আর দেরি না। আমি ওকে কথা দিয়েছি, আপনাদের দিয়ে গ্রেট ইস্টার্নে সাতটা সাড়ে সাতটার ভিতর পৌঁছব! আহ। বাঁচলুম, আল্লার কী মেহেরবানি।
আমি বললুম, এত নামাজ-রোজা করার পর আল্লা আপনাকে মেহেরবানি দেখাবে না তো দেখাবে কাকে? ওদিকে গাড়ির ভিতরকার আলো-অন্ধকারে না দেখেও যেন গাঢ় অন্ধকারেই বিদ্যুল্লেখার মতো উজ্জ্বলতম জ্যোতিতে দেখলুম, শহর-ইয়ারের গ্রেট ইস্টার্নে যাবার উৎসাহ ফ্রিজিং পয়েন্টেরও নিচে; আমারও তদ্বৎ। কিন্তু উপায় কী? ডাক্তারের বাবুলিং সফেন উত্তেজনা, তার অবিমিশ্র আনন্দ বরবাদ করতে পারে নিতান্ত পাষণ্ডজন। তদুপরি বেচারী ডাক্তার তো বারো মাস শুধু লেবরেটরি আর বাড়ি, এরই ভিতর মাকু চালায়। করুক না বেচারী একটুখানি ফুর্তি! আমরা দু জনা না হয় সারেঙ্গি-তবলার সঙ্গতই দেব।
হোটেলের সব কজন রেসেপসনিস্ট ওরকম লম্ফ দিয়ে উঠে ডাক্তারকে অতখানি সম অভ্যর্থনা জানায় কেন– ডাক্তার তো এখানে আসে অতিশয় কালেভদ্রে? লিফটের দিকে যেতে যেতে অনুমান করলুম, ডাক্তারের বাপ-ঠাকুর্দা এঁরা কলকাতার প্রাচীন খানদানি বিত্তশালী লোক; এ হোটেলে আসুন আর না-ই আসুন এরকম একটা হোটেল নিশ্চয়ই কোনও না কোনও সময়ে এঁদের আনুকূল্য পেয়েছে।
শহর-ইয়ার ও আমি দু জনাই চুপ। ডাক্তার কিন্তু সেটা আদৌ লক্ষ করেনি। এমনিতে মুখচোরা, লাজুক– এখন– এখন কেন, যবে থেকে আমাদের সঙ্গে দেখা সেই থেকে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। অনুমান করলুম, দিল্লি-আগত জনের সঙ্গে একদা নিশ্চয়ই বন্ধুত্ব তার সুগভীর ছিল। নইলে এত উৎসাহ, এত উত্তেজনা!
ভালো বড় ঘরই পেয়েছেন দিল্লির মেহমানদ্বয়।
ভদ্রলোকের পরনে অতি দামি কাপড়ের অত্যুত্তম দর্জির হাতে বানানো সুট। শার্ট, টাই একটু যেন বেশি আত্মপ্রকাশ করছে। সুপুরুষ না হলেও দ্র চেহারা। আর অতিথিকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তার আরামের ব্যবস্থা করাতে দিল্লির লোক পাকা, এটিকেট-দুরস্ত।
ম্যাডামটি কিন্তু কনট সার্কলের খাঁটি চক্রবর্তিনীদের একজন। সর্বপ্রথমই চোখে পড়ে এর ব্লাউজটি। সেটির নাম ব্লাউজ দেব, না কাঁচুলির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বলে উল্লেখ করব? এই পেটকাটা ব্লাউজ যে তাঁর শরীরের উত্তমার্ধ আচ্ছাদিত করার জন্য নির্মিত হয়নি সেটা দেখামাত্রই বোঝা যায়। সেটা যেন সে চিৎকার করে প্রচার করছে। আমরা ঘরে ঢোকার সময় তিনি তার শাড়ির ক্ষুদ্রতম অঞ্চলাংশ একবারের তরে তাঁর কাঁধে আলতোভাবে রেখেছিলেন। আমরা ভালো করে আসন নেবার পূর্বেই সেটি স্থানচ্যুত হয়ে ঊরুতে স্থূপীকৃত হল। এর পর সেটি আর প্রমোটেড হয়নি। আমি ভাবলুম, শাড়ি ছেড়ে ইনি রাজপুতানিদের মতো ঘাগরা পরলে তো অনেকখানি কাপড়ের সাশ্রয় হয়। কিন্তু এই বাহ্য। আসল দেখতে হয় তাঁর মেক আপ। এরকম চুলের ঢপ আমি ইতোপূর্বে কখনও দেখিনি– খুব সম্ভব প্যারিসের ফ্যাশান পত্রিকা দেখে দেখে হেয়ার ড্রেসার তাঁর মাথার উপরকার ওই তাজমহলটি নির্মাণ করেছে। ঠোঁটে যে রঙ মেখেছেন সেটা লাল তো নিশ্চয়ই নয়, হয়তো ব্রোজ বলা যেতে পারে। নখের রঙ অলিভ গ্রিন। কিন্তু সংস্কৃত কবিকুলের মতো আমি যদি তার দেহ এবং প্রসাধন এস্থলে দফে দফে বর্ণাতে যাই তবে সর্বপ্রথমই আমাকে বৎসরাধিক কাল তার প্রসাধন নির্মাণে যে-সব গূঢ় রহস্যাবৃত রসায়নাদি সাহায্য করেছে তাদের নিয়ে একাগ্রমনে গবেষণা করতে হবে। ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিকগণ অবহেলে থার্মোমিটার দিয়ে শরশয্যায় শায়িত ভীমের টেম্পারেচার অর্জুনকে দিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু এ যুগের বর্ণনাতে আমি ব্রা-র নম্বর নিয়ে গুবলেট করলে কেউ তো আমায় ছেড়ে কথা কইবে না।