সে আবার কী? মনে হচ্ছে ফারসি। বুঝিয়ে বলুন।
আমি বললুম, সমূহ মুশকিলে আমাকে ফাসালেন। দোহাটি শুনেছি গুরুর কাছে ওস্তাদ বললুম না, কারণ তিনি ছিলেন কনৌজের কট্টর গোড়া ব্রাহ্মণ এবং জানতেন উৎকৃষ্টতম ফারসি–আমার বয়েস যখন তেরো-চোদ্দো। তার পর এটি আমি অন্য কারও মুখে শুনিনি, ছাপাতেও দেখিনি। কাজেই আমার পাঠে ছন্দপতন ও যাবতীয় গলদ থাকার প্রভূত সম্ভাবনা। অর্থ হচ্ছে এই, শেষবিচারের দিন (দর কিয়ামৎ) প্রত্যেককেই (হর কস) সে সমস্ত জীবন ধরে যা যা পাপকর্ম, পুণ্যকর্ম করেছে এবং করেনি তারই একটি পুরো রিপোর্ট (আমলনামা বা শুধু নামা বা নাম) আপন আপন হাতে ধরে (দস্তু গির) দাঁড়াবে। আমিও নিজে (মন্ নিজ) হাজির হব (হাজির মিশওম) বগলদাবায় (দ বগল) প্রিয়ার তসবিরটি (তসবিরে জানা) নিয়ে।
অর্থাৎ ওই লোকটি সেই শেষ বিচারের সর্বমান্য পাক-পবিত্র বিচারপতিকে বলবে, অন্যেরা আপন আপন কৃতকর্মের পুরো বয়ানের আমলনামা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে, কিন্তু হুজুর, আমার কোনও আমলনামা নেই। তার কারণও সাতিশয় সরল। আমি সমস্ত জীবন ধরে আর-কিছু করিনি– জীবনভর শুধু আমার প্রিয়ার ছবিটি এঁকেছি আর দেখেছি, দেখেছি আর একেছি। সেইটিই আমার কৃতকর্মের আমলনামা। এই নিন, হুজুর, দেখে নিন! তাই বলছিলুম, অষ্ট-অলঙ্কার-পরা আপনার এখনকার একটি ছবি আমাকে দিন। নইলে শেষ বিচারের আদালতে জেরার চোটে আমার জেরবার হয়ে যাবে– একসিবিট নাম্বার ওয়ান অ্যান্ড লাস্ট না থাকলে।
শহর-ইয়ার বললেন, আমার অল্প বয়সে আমাদের বাড়িতে প্রায়ই মৌলবি-মৌলানা আসতেন। তখন এরকম কল্পনাতীত, অসম্ভব অসম্ভব প্রেমের দোহা অনেকগুলো শুনেছি। এসবেতে অতিশয়োক্তি নিশ্চয়ই, তবু কেমন যেন মনে হয়, ওই যুগে ওরা বোধ হয় আমাদের তুলনায় প্রেমের মূল্য দিত ঢের ঢের বেশি। আচ্ছা, সে তত্ত্ব বাদ দিয়ে আপনার বর্তমান সমস্যা সমাধানের জন্য পরামর্শ দিই; আপনি আমার ছবি আঁকুন!
আমি ভীত রুদ্ধ কণ্ঠে বললুম, আর হঠাৎ যদি শবৃনম্ এসে পড়ে ছবিটা দেখে? ও তো আসবে অতি অবশ্যই। ও যাবার সময় যখন বলে গিয়েছিল সে ফিরে আসছে তখন সে আসবে নিশ্চয়, দৃঢ় নিশ্চয়।
তাচ্ছিল্যভরে শহর-ইয়ার বললে, এখন এলে আপনি তাকে চিনতেই পারবেন না।
রীতিমতো তাজ্জব বনে বললুম, আপনার মুখে এই কথা! আপনার অনুভূতির কলিজাটা না রবিঠাকুরের কিমা-মেশিনে তুলো-পেঁজা হয়ে গিয়েছে! শবনমের অনন্ত তারুণ্য তো কখনও পরিবর্তিত হতে পারে না তাকে তো আমি গড়েছি আমার জিগর কলিজার বিন্দু বিন্দু খুন দিয়ে এবং সে নির্মাণ বহু শত যোজন পেরিয়ে এখনও পূর্ণোদ্যমে অগ্রগামী। আচ্ছা, এ যুক্তিটা না হয় বাদই দিন। ধরুন, একশ বছর পরে নিতান্ত দৈবদুর্ঘটনাবশত কিংবা কোনও ছোকরা লাইব্রেরি-অ্যাসিসটেন্ট শন সম্বন্ধে লিখিত আমার আর পাঁচখানা নগণ্য পুস্তকের মতো এই পুস্তকখানি পড়ল, নিতান্ত অনিচ্ছায়, সুদ্ধমাত্র বইটা ক্যাটালগের কোন কোঠে পড়বে সেইটেই ঠাহর করার জন্য। একশো বছর পরে পড়ছে বলে কি আপনার ধারণা শবৃনম্ তখন একশো বছর বয়সের জরাজীর্ণা বৃদ্ধা হয়ে সে ছোকরার সামনে আবির্ভূত হবে?
রসভঙ্গ করে ড্রাইভার বিনয় কণ্ঠে শুধালে, সরকার, যাব কোথায়?
সাহেব যেখানে কাজ করেন।
ককিয়ে উঠে শহর-ইয়ার বললে, ওই রসকসহীন জায়গায় যাবার জন্য আমি এই বেশভূষা সর্বাঙ্গে চড়ালুম! হা আমার কপাল! এ কপাল কি আর কখনও বদলাবে না? আপনার সঙ্গ পেয়েও না? আরেকটু হলে কেঁদে ফেলত আর কি!
আমি দৃঢ় কণ্ঠে বললুম, আপনি আমাদের ইসলামের কিছুই জানেন না। তা হলে অবহিতচিত্তে শ্রবণ করুন একটি হদিস। জ্ঞানসঞ্চয় এবং পুণ্যলাভ দুই-ই হবে। অবশ্য আমি ঘটনাটি শব্দে শব্দে টায় টায় বলতে পারব না, কিন্তু প্রতিপাদ্য বিষয় বর্ণনে যে কোনওপ্রকারে উনিশ-বিশ হবে না তার জিম্মাদারি আমি নিচ্ছি– যদিও আল্লাই সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বজ্ঞ (ওয়াল্লাহু আলম!)
একদা এক অভিযানান্তে আল্লার পয়গম্বর যখন তাঁর সঙ্গীসাথীসহ তাদের বাসভূমি মদিনা শহরে প্রত্যাবর্তন করছেন, তখন তিনি লক্ষ করলেন, দলের এক আরব যুবা বড় অসহিষ্ণুভাবে তার উটকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সক্কলের আগে আগে যাবার চেষ্টা করছে। আরবরা বড়ই সাম্যবাদী– এরকম অবস্থায় দলের মুরুব্বিরাই যে দলের পুরোভাগে থাকবেন এমন কোনও বাধা-ধরা নিয়ম নেই। তৎসত্ত্বেও ওই যুবাটির অসহিষ্ণুতা হজরতের চোখে পড়ল। তিনি তাঁর পাশের উট-সওয়ারকে শুধালেন, ব্যাপার কী? লোকটার অত তাড়া কিসের? সে বলল, হে আল্লার প্রেরিত পুরুষ! এ যুবা অতিসম্প্রতি বিবাহ করেছে। তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে চায়। হজরত বললেন, আচ্ছা, ওকে আমার কাছে একবার ডেকে নিয়ে এসো তো। হজরতের আহ্বান শুনে যুবা শ্লাঘা অনুভব করে তাঁর কাছে এল। হজরত বললেন, বৎস, শোনো। তুমি যদি সক্কলের পয়লা পয়লা উট চালিয়ে সক্কলের পয়লা আপন বাড়িতে পৌঁছে যাও তবে খুবসম্ভব দেখতে পাবে তোমার নববিবাহিতা বধূ এই আকস্মিক প্রত্যাবর্তনের সংবাদ জানত না বলে বিরহিণী হয়তো তার আটপৌরে অতিশয় মামুলি বেশভূষা অযত্নে অবহেলায় পরিধান করে বিষণ্ণ বদনে বসে আছে। সে দৃশ্য তোমার মনঃপূত না-ও হতে পারে, তুমি পুলকিত না-ও হতে পারো। পক্ষান্তরে তুমি যদি দলের সকলের পিছনে থাক তবে যে-মুহূর্তে মদিনাবাসী দলের পুরোভাগ দেখতে পাবে তনুহূর্তেই শহরের সর্বত্র আনন্দ-দামামা বেজে উঠবে, এবং যেহেতু তুমি দলের সর্বপশ্চাতে আছ তাই বাড়ি পৌঁছতে তোমার সময় লাগবে বেশি ইতোমধ্যে তোমার বধূ সেই অবসরে উত্তম প্রসাধন করে, উৎকৃষ্ট বেশভূষা ধারণ করে তোমাকে প্রসন্ন অভ্যর্থনা জানাবার জন্য প্রফুল্ল বদনে তোমার জন্য অপেক্ষা করার সুযোগ পাবে। তাই বলি, শর-ইয়ার আপনার সর্বোৎকৃষ্ট অলঙ্কার, আপনার মধুরতম মৃদুহাস্য কার জন্য? অপরিচিতজনের জন্য, পথগামী জনতার জন্য সেখানেও মনে রাখবেন রাস্তাঘাটে স্বেচ্ছায় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ-অলঙ্কার প্রদর্শন ইসলামে নিন্দনীয়। অতএব আপনার বেশভূষা নিশ্চয়ই অপরিচিতজনের জন্যে নয়। আপনি যখনই স্বামীর কাছে যাবেন তখন আপনার বেশভূষা হবে রাজরানির মতো, তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন যেন তিনিও আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষের রাজাধিরাজ, এবং তিনিও যখন আপনার কাছে আসবেন তখন আসবেন সম্রাটের বেশে এবং আপনার সঙ্গে কথা বলবেন যেন আপনি রাজরাজেশ্বরী।