মাদাম আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, আপনার বাড়ি সবদিক দিয়ে আমার অনেক বেশি ভালো লাগে। সেখানে আমার দেহমনে এক অপূর্ব নিরবচ্ছিন্ন শান্তি নেমে আসে। ওই একটিমাত্র জায়গা যেখানে আল্লাকে শুকর দেবার জন্য তসবি জপতে ইচ্ছে করে।
আমি বললুম, হুঃ! দিলজান শেখের রান্না– তা-ও বোলপুর হাটে যা পাওয়া যায় সেই আড়াইখানা শুকনো পটোল, চিমসে উচ্ছে আর সজনের ডাটা, সুপিচ্ছিল কলাইয়ের ডাল, ঝিঙে-পোস্ত তদাভাবে বড়িপোস্ত দিয়ে, কুকুরের জিভের মতো যে রুটিকে টেনে-টেনে খাবার টেবিলের এসপার-ওসপার করা যায় তাই দিয়ে ব্রেকফাস্ট। তার পর শোবার জন্য শক্ত কাঠের তক্তপোশ এবং বাথরুমে কলের জল নেই। এমনকি সেই আদ্যিযুগের গ্রামোফোনটা বাজাতে গেলে দম দিতে দিতে হঠাৎ বেবাক হাতখানা ধড় থেকে আলাদা হয়ে যায়। রাত্রে, হয় এমনি নিষুতি নিঝঝুম যে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়, নয় শেয়ালের কনসার্ট ঘণ্টার পর ঘণ্টা নাগাড়ে।
আবার বলি, হুঁ! রমণীর রুচি যে কত বিদকুটে, বদখৎ হতে পারে এই তার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ?
হঠাৎ মুখ তুলে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে দেখি, শহর-ইয়ারের দু গাল বেয়ে জল পড়ছে।
আমি হতবুদ্ধি হয়ে মাফ চাইতে গিয়ে কী যে অসংলগ্ন কথা তোতলাতে তোতলাতে বলেছিলুম সেটা তখনও নিজেই বুঝতে পারিনি এবং এখন স্মরণে আনা তো সম্পূর্ণ অসম্ভব।
কিন্তু আল্লার কী আপন হাতে গড়া এই মেয়ে শহর-ইয়ার! আমার বিহ্বল অবস্থা দেখে সঙ্গে সঙ্গে সে তার সম্পূর্ণ আত্মকর্তৃত্ব কব্জায় এনে দু চারটি কথা দিয়ে আমাকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবার মতো অবস্থার সৃষ্টি করে দিল। বললে, আমার রসিকতাবোধ ইদানীং বড্ড কমে গেছে কতকগুলি আকস্মিক অপ্রিয় ঘটনা ঘটে যাওয়ায়। এই যা সব এখনি বললেন, তার সবকটি কথা সত্য, কিন্তু আপনার কাছে মিথ্যা, আমার কাছে আরও মিথ্যা। যদি সত্যই হবে, তবে আমি আপনার বাড়িতে প্রতিবার আসামাত্রই এত প্রাণভরা আনন্দে আমার দিকে এগিয়ে আসেন কেন, আপনার বুকের ভিতর থেকে উচ্ছ্বসিত হয়ে বেরিয়ে আসে না আপনার মহব্বৎ, আপনার প্যার, আপনার হাঁক-ডাক, চেল্লা-চেল্লিতে? কই, আপনি যেসব অনটন-অসুবিধার লিস্টি দিলেন তার দুর্ভাবনায় তো ক্ষণতরেও আপনাকে প্রকুঞ্চন করতে দেখিনি। মনে আছে, একদিন রুটি খারাপ ছিল বলে টোস্টগুলো মিইয়ে যায়- কই, আপনি তো একবারও আমাদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করেননি বা ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেননি। তবে আজ হঠাৎ এসব কেন? দেখুন সিতারা সাহেব–
এবারে আমি বিস্ময়ের যেন বিজলি শক খেয়ে শুধালুম, আমার ডাকনামটা আপনাকে বললে কে?
মোনালিজার মতো রহস্যভরা নয়নে তাকিয়ে বললে, যদি বলি এটাও ওই তর্কের মতো উপস্থিত ধামাচাপা দিয়ে মুলতবি রাখা যা, তবে আপনার আপত্তি আছে?
আমি বললুম, হরগিজ নহি। যে কোনও একদিন বললেই হল।
এতক্ষণ খাচ্ছিল বলে শহর-ইয়ার কোনও গান ধরতে পারেনি। সে-কর্ম সমাধান হতেই সিতারা (তারা) তাকে টুইয়ে দিল ওই কর্মে ফিরে যেতে। শুরু করল,
নিবিড় ঘন আঁধারে
জ্বলিছে ধ্রুবতারা
মন রে মোর পাথারে
হোসনে দিশেহারা!
অনেকক্ষণ ধরে চোখ বন্ধ করে গাইল। বুঝলুম, এটি তার বিশেষ প্রিয় গান।
আমি বললুম, ভুলবেন না অখণ্ড সৌভাগ্যবতী শহর-ইয়ার, এই গানের মূলমন্ত্রটি– শোভন এই ভুবনে রাখিয়ো ভালোবাসা। আর কাজের কথা শুনুন– অবশ্য গানের মূলমন্ত্রটি সর্বকাজের চেয়েও মহান আজ সাড়ে ছ টার সময় আপনার সঙ্গে আমার রাঁদেভু কয়েক মিনিট আগে এলেই ভালো এবং বাইরে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে আসবেন, প্লিজ। পটের বিবি সাজতে পারেন, না-ও পারেন। সাজবার সময়কার মুড়মাফিক। আচ্ছা, গাড়িটা পাওয়া যাবে তো?
নিশ্চয়ই। কিন্তু বলুন তো, আমায় কোথায় নিয়ে যাবেন?
এমনই সাদামাটা সর্ব রোমান্স বিবর্জিত স্থলে যে সেটা সত্যি বলার মতো নয়। কাজেই সর্ব সারপ্রাইজের ভয়-ভরসা বর্জন করে দিন এই বেলাই।
শহর-ইয়ার
নিশিদিন ভরসা রাখিস
ওরে মন হবেই হবে
গুনগুন করতে করতে চলে গেল।
.
০৭.
‘হা। । । জির!’ হাটার উচ্চারণ আরবি কায়দায় যতদূর সম্ভব দীর্ঘ এবং জিরটি সেই অনুপাতে হ্রম্বের চেয়েও হ্রস্ব।
আমি বললুম, এ কী! এ যে একেবারে রাজরাজেশ্বরীর বেশে সেজেছেন? সঙ্গে সঙ্গে গান ধরল,
তোমায় সাজাবো যতনে কুসুমে রতনে
কেয়ূরে কঙ্কণে কুঙ্কুমে চন্দনে।
পূর্বেই বলেছি, পুরোপাক্কা বঙ্গ হিন্দুরমণীর বেশ পরলেও শহর-ইয়ারের সঙ্গে হিন্দুরমণীর কোথায় যেন একটা পার্থক্য থেকে যায়। উঁহু! মাথায় এক থাবড়া সিঁদুর বসিয়ে দিলেও সে পার্থক্য ঘোচবার নয়। এতদিন তাকে প্রতিবারেই দেখেছি সাদামাটা বেশে; আজকের এ বেশেও সেই পার্থক্য, বরঞ্চ একটু বেশি।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললে, কেন? আমার কি সাজতে সাধ যায় না?
আমি বললুম, এর অনেক বেশি ঘন ঘন যাওয়া উচিত। সাজসজ্জা করলে সকলেরই যে সৌন্দর্যবৃদ্ধি হয় তা নয়। এবং কারও কারও বেলা মনে হয় এ যেন ভিন্ন, অচেনা জন। আপনার বেলা দুটোর একটাও নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা আপনি আপনার সৌন্দর্য সম্বন্ধে যেরকম সম্পূর্ণ অচেতন থেকে সেটিকে অবহেলে ধারণ করেন, আপনার সাজসজ্জা প্রসাধনও আপনি ঠিক সেইভাবে দেহে তুলে নিয়েছেন। মনে হয়, আপনি এই বেশেই নিত্যদিনের গৃহকর্ম করেন, ঘৃতলবণতৈলতবস্ত্রইন্ধন সমস্যা সমাধান করেন। যে কথাগুলো বললুম তার সবকটি আমি শেষবিচারের দিনের সৃষ্টিকর্তার সামনে, ডাক পড়া মাত্র, আপনারি মতো হা। । । জির বলে কসম খেয়ে বলতে রাজি আছি অবশ্য যদি এইবেলা এই বেশে আপনি আপনার একটি ছবি তুলিয়ে দেন– কারণ তসবিরে জার্না সে সময় দর-বগল না হলে চলবে না।