চলতে চলতে বললেন, আপনার লোক দিলজান শেখও বলছিল আপনি লাঞ্চের তোয়াক্কা করেন না। ডিনারও নাকি প্রায়ই মিটসে থেকে বের করে রাতদুপুরে খান। কিন্তু এ বাড়িতে আমি বে-চারা, নিরুপায়। ইসলামি অনুশাসন অনুসারে এ বাড়িতে শতাধিক বর্ষ ধরে অলঘ্য ঐতিহ্য, প্রভু-ভৃত্য খাবেন একই খানা। চাকররা সরু চাল খেতে পছন্দ করে না এই আর্জি পেশ করায় কর্তা সরু চাল ছেড়ে দিয়ে মোটা ধরেছেন! আমার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে ওরা মোড় থেকে মাঝে-মধ্যে ফুচকা নিয়ে আসে– জানেন তো কীরকম ধুলোবালির সঙ্গে মিলেমিশে সে-ফুচকার মাটির শরীর। কোনওদিন যদি দৈবাৎ ওঁর চোখের সামনে পড়ে যায় তবে সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে লম্ফ দিয়ে ঠোঙা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চিৎকার, দে, দে আমায় দে। একা একা খাসনি। গুনাহু হবে। শুনুন, মশাই, শরিয়তের অভিনব ব্যাখ্যা! চাকরকে না দিয়ে মুনিব যদি একা একা খুশ খানা খায় তবে সেটা অশোভন (মকরূহ) বলা হয়েছে, গুনাহ্ (পাপ) কি না জানিনে, কিন্তু মুনিবকে বাদ দিয়ে চাকর যদি- এবং সেটা মুনিবেরই পয়সায়– মামুলিই কিছু একটা খায় তবে নাকি সেটা চাকরের গুনাহ্। আবার ফুচকা খেতে খেতে গম্ভীর কণ্ঠে সদুপদেশ বিতরণ : দ্যাখ, রাস্তার ফুচকা খানি। জার্মটার্ম থাকে। অসুখ-বিসুখ করে। তার পর আবার বিড়বিড় করে বলেন, বাড়ির ফুচকা কিন্তু অখাদ্য রদ্দি। এই তো এখানকার হাল। অতএব আপনি খান আর না খান, আমি খাই আর না খাই, দুপুরের রান্না হবে ঠিক ঠিক। কাল সন্ধ্যায় দেখলেন না, ঘরের পর ঘর সাজানো– জনপ্রাণী নেই? এটাও ঐতিহ্য!
আমি বললুম, আরেকটা কথা। আজ বিকেলে সাড়ে ছ টায় আপনাকে নিয়ে আমার প্রয়োজন। অবশ্য আপনার যদি ওই সময় অন্য কোনও কাজ না থাকে।
কী ব্যাপার? আমার তো ভয় করছে।
আমি হাসতে হাসতে বললুম, রত্তিভর ভয়ের কারণ নেই। বঙ্গবালাদের অবশ্য সবই হিন্দু– লাজুক তবিয়ৎ বাবদে আমি ওয়াকিফহাল।
উনি গান গাইতে গাইতে বিদায় নিলেন,
জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না,
হায় ভীরু প্রেম, হায় রে।
দুপুরে খেতে বসার সঙ্গে সঙ্গে শহর-ইয়ার বললেন, ক বার যে গিয়েছি আপনার বন্ধ দরজার কাছে! দোরে কান পেতে না দেখেও স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি আপনি পড়ছেন। তাই দোরে টোকা দিইনি।
আমি বললুম, সর্বনাশ করেছেন। আমি জাগ্রত অবস্থায় কিছু-একটা না পড়ে থাকতে পারিনে। আর সর্বক্ষণ পড়ি বলে যে কোনও সময়ে যত ঘণ্টার জন্য চান আমি সে পড়া মুলতুবি রাখতে পারি। তাই আপনি যে সময় খুশি যত ঘণ্টার তরে খুশি আমার কাছে এসে গল্প করতে পারেন, রেকর্ড বাজাতে পারেন যা খুশি তাই। ও! অত প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন কেন? বিস্তর পড়ি বলে? হায়, হায়, হায়! জানেন, মাথা থাবড়াতে ইচ্ছে করে যখন কেউ বলে, কিংবা তার মুখের ভাব থেকে বুঝতে পারি যে, সে ভাবছে, আমি পড়ে পড়ে জ্ঞানসমুদ্রের গভীর থেকে গভীরতর স্তরে ডুব দিচ্ছি। বিশ্বাস করুন, কসম খেয়ে বলছি, জ্ঞান যৎসামান্য একটু-আধটু হয়তো মাঝে-সাঝে বাড়ে, আসলে কিন্তু আমি পড়ি ওটা আমার নেশা, নেশা, নেশা। এক্কেবারে নেশার মতো। মাতালকে শুধোবেন, সে বলবে, প্রথম দু তিন পাত্তর তার দেহমনের জড়তা কাটে, সে সময় মনে ফুর্তিও লাগে কিন্তু তার পর যে সে খেয়ে যায় সেটা নিতান্তই মেকানিকেলি। সর্বশেষে সে নিস্তেজ হয়ে আসে, তবু খাওয়া বন্ধ করে না। তাই তো ওটার নাম নেশা। যতক্ষণ মদ তাকে আনন্দ দিচ্ছে ততক্ষণ তো সেটা কাজের জিনিস খুব বেশি গালাগাল দিতে চাইলে হয়তো বলতে পারেন বিলাসিতা কিন্তু যখন সেটা আর আনন্দ না দিয়ে তাকে নিস্তেজ থেকে নিস্তেজতর স্তরে নামিয়ে নিয়ে যায় তখন সেটা রীতিমতো নিন্দনীয় নেশা। আমার পড়া ওই ধরনের। আপনার চোখ থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারছি আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। আরেক দিন না হয় আরও গভীরে গিয়ে আপনাকে বোঝাব। আপনিও যদি না বোঝেন তবে আমার শেষ নোঙর ভাঙল।
কিন্তু আপনার কর্তার বেলা ব্যাপারটা অন্যরকম। প্রথমত তার বয়েস কম বলে এখনও বহু বৎসর ধরে তাকে নানারকম তথ্য ও তত্ত্ব সঞ্চয় করে জ্ঞানবৈভব বাড়াতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, তারই সাহায্যে তাঁর জীবনদর্শন– জর্মনরা বলে ভেন্টআনশাউউঙ, গড়ে উঠবে। সব জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার আদর্শ এই জীবনদর্শন নির্মাণ করা। কিন্তু আজ এখানেই ফুলস্টপ না, ফুলেস্ট স্টপ!
শহর-ইয়ার বললেন, আচ্ছা। এখনকার মতো না হয় বিশ্বাসই করে নিলুম।
বললুম, শাবাশ! এই জন্যই তো আপনাকে এত ভালোবাসি। তর্কাতর্কি অত্যুত্তম প্রতিষ্ঠান কিন্তু সেটা সময়মতো, কিছু সময়ের জন্য, মুলতুবি রাখার মতো সহিষ্ণুতা আর বদান্যতা যেন দিলের ভিতর থাকে। গায়ের মেয়েরা অবশ্য কোঁদল মুলতুবি রাখে অন্য কারণে। সংসারের কাজে ফিরে যেতে হবে বলে দুই লড়নেওয়ালি তখন জিহ্বা সংবরণ করে অদৃশ্য কাগজকালিতে টেম্পরারি আর্মিস্টিস সই করে; এবং তার প্রতীক, দু জনা দুই শূন্য ধামা ধপ্ করে মাটিতে উবু করে কোদলটা ধামাচাপা দিয়ে রেখে যার যার ঘরে চলে যায়। কাজকর্ম শেষ হলে উভয় পক্ষ রণাঙ্গনে ফিরে এসে ধামাদুটো তুলে নিয়ে কোদলকে দেয় নিষ্কৃতি। তার পর ফিন্ গুরুসে।
কিন্তু, মাদাম, বললে পেত্যয় যাবেন না, এই যে রেজালা নামক সরেস জিনিসটি খাচ্ছি, এটা যে তৈরি করেছে সে মাইকেল এঞ্জেলো রান্নার কলাসৃষ্টিতে।