হঠাৎ যেন নতুন অনুপ্রেরণা পেয়ে বললেন, আপনার বাগচী, ভটচা, চাটুয্যে চেলাদের একদিন ডাকুন না এখানে, কলকাত্তাই মোগলাই খানা খেতে? দোস্ত আপনাদের? না, তা হলে বোধ হয় ঠিক জমবে না। আলাদা আলাদা করে দাওয়াত করলেই ভালো। কী বলেন আপনি?
আমি নষ্টামির চোখে বললুম, তার চেয়ে শহর-ইয়ার তার বান্ধবীদের স্মরণ করুন। তাঁদের সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ করে সেই গোলাপজলে শুকনো জানটাকে ভিজিয়ে নেব।
ডাক্তার যেন সন্মুখে ভূত দেখতে পেয়ে বললেন, ওরে বাপরে! ওর মতো জেলাস আর পজেসিভ রমণী আপনি ত্রিসংসারে পাবেন না। বরঞ্চ আপনাকে-আমাকে দু জনাকে চিরজন্মের মতো যমের হাতে ছেড়ে দেবে, তবু তার বান্ধবীর হাতে এক মিনিটের তরেও ছাড়বে না হোক না সে বান্ধবীর বয়েস নব্বই।
টেবিল ছেড়ে উঠে বললেন, তা হলে স্যর, খুদা হাফিজ টিল উই মিট এগেন।
বউয়ের দিকে তাকিয়ে একটু লাজুক হাসি হেসে বুলেট-বেগে বেরিয়ে গেলেন।
অনেকক্ষণ পরে ম্লান হাসি হেসে শহর-ইয়ার বললেন, আপনি সত্যি বিশ্বাস করেন, তিনি আজ সাতটায় ফিরবেন? সময়মতো ফেরা, না-ফেরা কি ওঁর এখতেয়ারে? সেটা তো সম্পূর্ণ তাঁর কাজের নেশার হাতে। নেশা না কাটা পর্যন্ত কি মাতাল দাঁড়িয়ে উঠে চলতে পারে? আজ যদি সাতটায় কাটে তো ভালো। আর যদি তার বদলে দশটায় কাটে, তবে সেটা কাটার পর, ওই মাতালেরই মতো আপনার পা ধরে মাফ চাইবেন একশো বার, হাজার বার। আপনাকে উনি যা শ্রদ্ধা করেন তাতে আপনাকে অবহেলা করা তাঁর স্বপ্নেরও বাইরে। কিন্তু নেশা জিনিসটা নেশা। কাজের নেশা, ঘোড়ার নেশা, প্রেমের নেশা।
একটু ভেবে নিয়ে দুঃখের সুরে বলেন, আমার যদি কোনও একটা নেশা থাকত তা হলে এই জীবনের অন্ধকূপের তলায় দিব্য মাতাল হয়ে পড়ে রইতুম।
আমি বললুম, আপনি না-হক পেসিমিস্ট।
আমি পেসিমিস্ট নই। আমি ইমোশনাল– বড্ড বেশি স্পর্শকাতর– মাত্রাধিক অনুভূতিশীল। এবং তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী আপনার গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ। তাঁর শত শত গানের শত শত মেশিনের ভিতর দিয়ে আমার কলিজাটাকে এপার-উস্পার করে কিমা-কিমা বানিয়ে ছেড়েছেন। তবে এখন আর এসব কথা বলব না। এ প্রসঙ্গের জন্য পুণ্যলগ্ন রাত্রে, গান শোনার মাঝে মাঝে। আর ওই আমার কর্তাটি যে বললেন, আমি জেলাস, আমি পজেসিভ, সেটা উনি চিন্তা না করে বলেছেন–
আমি বললুম, কী বলছেন! উনি মশকরা করেছেন।
না, উনি চিন্তা না করেও একদম খাঁটি সত্য কথা বলেছেন। আমি খুব ভালো করেই জানি আমি জেলা এবং আমার হক্ক আমার সম্পদ সম্বন্ধে সর্বক্ষণ সচেতন। তবে হ্যাঁ, আমি লড়নেওয়ালি নই। কেউ হামলা করলে আমি তখন আমার চোখের জলের সঙ্গ খুঁজি।
আমি বললুম, খাঁটি মুসলমান বঙ্গরমণী! কোথায় গেল মুসলমান পাঠান রমণীর দৃপ্তকণ্ঠের জঙ্গি জবাব, না, কবুল না।
গুনগুন করে গান ধরল, কেন চোখের জলে ভাসিয়ে দিলাম না রে। সঙ্গে সঙ্গে দিব্য লাঞ্চের টেবিল সাজানো, ব্রেকফাস্টের জিনিস সরিয়ে নিয়ে যথাস্থানে রাখা, ফাঁকে ফাঁকে রান্নাঘরের তদারকি করা, বাঙলা কথায় পুরো গেরস্থালির কাজ করে যেতে লাগল– গান গাওয়াতে কোনও খিরকিচ না লাগিয়ে। বাইরে থেকে যে কেউ সে গাওয়া শুনে নিঃসন্দেহে ভাবত, চোখ বন্ধ করে প্রাণমন ঢেলে তন্ময় হয়ে কেউ গানটি গাইছে।
শেষ হলে আমি বললুম, আমার মতের মূল্য অনেকেই দেয়, তাই বলছি, আপনি বড় সুন্দর গাইতে পারেন। কিন্তু বাইরে, মজলিসে কোথাও গেয়েছেন বলে শুনিনি, কাগজেও দেখিনি।
বললে, একই বিষয়বস্তু কেউ লেকচাররূপে সভাস্থলে প্রকাশ করে, অন্যে ঘরের ভিতর পাঁচ-কথার মাঝখানে বলে। আমার গান যদি সত্যিই সেটা গানের স্তরে ওঠে– দ্বিতীয় পর্যায়ের। বাড়িতে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে, এ গান তার জায়গা খুঁজে নিয়েছে। সভাস্থলে গাইলে নিশ্চয়ই আমার গান আড়ষ্ট শুষ্ক কাষ্ঠ হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে একটি গানের মাঝখান থেকে গেয়ে উঠলেন–
সভায় তোমার ও কেহ নয়,
ওর সাথে নেই ঘরের প্রণয়
যাওয়া-আসার আভাস নিয়ে
রয়েছে এক পাশে।
এ গানের ঘরের প্রণয়ীও নেই। নিতান্ত আমার কাজকর্মের নিরালা দিনের, নির্জন অবসরের একপাশে পড়ে থেকে বেচারী আমাকে সঙ্গ দেয়।
নজরুল ইসলামের গানে শখ নেই? আর কিছু না হোক, মুসলমান হিসেবে, অন্তত যেগুলোর যোগ আমাদের ধর্মের সঙ্গে আছে?
আছে, কিন্তু মুশকিল স্বরলিপি যোগাড় করা। আর যেভাবে সচরাচর গাওয়া হয় সেটা আমার পছন্দ নয়। কুক্ষণে তিনি বিদ্রোহী রচেছিলেন। গাওয়াইয়ারা এখন তাঁর শান্ত লিরিক গানেও ওই বিদ্রোহী সুর লাগান। বিলকুল বেখাপ্পা। এমনকি বিশ্বাস করবেন না, তাঁর ঝিঙে ফুলের মতো লক্ষে গোটেক, ধরা-ছোঁয়ার বাইরের নাজুক কবিতাটিও আবৃত্তি করা হয় মোশন ঢুকিয়ে, জোশ লাগিয়ে! বদখদ বরবাদ! চলুন, আমার কাজ উপস্থিত এখানে খতম। বাজার আসুক; তখন দোসরা কিস্তি।
আমি বেরুতে বেরুতে বললুম, একটি রেওয়াজ আমি পৃথিবীর সর্বত্রই লক্ষ করেছি। স্বামী স্ত্রী ভিন্ন অন্য তৃতীয় প্রাণী যে বাড়িতে নেই, এবং স্বামী লাঞ্চ খেতে বাড়ি আসেন না, সেখানে স্ত্রী লাঞ্চ ব্লাঁধে না। কী খায় সে অবশ্য দেশভেদে খাদ্য ভেদ। জানিনে লাঞ্চের পরিবর্তে আপনি কী খান। বিশ্বাস করুন আমি সেই খেয়েই সন্তুষ্ট হব। সে আমার জন্য আসমান-জমিন স্থানচ্যুত করে আগা খানের খাওয়ার মতো লাঞ্চ তৈরি করতে হবে না।