আমার সুখ-দুঃখের অনুভূতি, আমার মান-অভিমান, বিরহ-মিলনের অশ্রুপাত, আনন্দোল্লাস, আমার সর্বপ্রকারে সূক্ষ্মানুভূতি, স্পর্শকাতরতা– সব, সব নির্মাণ করেছে, প্রাণবন্ত করেছে রবীন্দ্রনাথের গান; সেই শত শত গানই শিল্পী– স্রষ্টা!
আমি চুপ করে, কোনও বাধা না দিয়ে প্রত্যেকটি শব্দ হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করছিলুম। বললুম, আমরা হিন্দু আর মুসলমান মেয়ের হৃদয়বৃত্তি নিয়ে আলোচনা করছিলুম। সেই সুবাদে আপনাকে একটি প্রশ্ন জিগ্যেস করি। রবীন্দ্রনাথ তার ধর্মসঙ্গীতে যে চরম সত্তার কাছে আত্মনিবেদন করেছেন তিনি তো মুসলমান সুফিদের অল-হ পরম সত্য সত্তাস্বরূপ। এ গানগুলো আরবি বা ফারসিতে অনুবাদ করলে কারও সাধ্য নেই যে বলতে পারে এগুলো রচেছে এমন এক কবি যে মুসলমান নয়। আপনি মুসলমান। এ গানগুলো শুনে আপনার হৃদয় কি রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানের চেয়ে বেশি সাড়া দেয়?
গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বললে, ওইখানেই তো ট্র্যাজেডি। কয়েকটি ব্যত্যয় বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ ধর্মসঙ্গীতই আমার বুকে তুফান তোলে না। তুললে তো আমার সব সমস্যা ঘুচে যেত। আমার দেহমন সেই চরম সত্তার কাছে নিবেদন করে পরমা শান্তি পেতুম। একেই তো বলে ধর্মানুরাগ। বরঞ্চ দেখুন, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না, আল্লা মানুষের রূপ ধারণ করে অবতাররূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন এবং তৎসত্ত্বেও যে ধর্মসঙ্গীতটি আমার হৃদয়ের ভিতর দুরন্ত তুফান তোলে, সেটি–
মেরে তো গিরিধর গোপাল
দোসরা তো কোঈ নহি রে—
চরম অসহায় অবস্থায় এ ভজনটি যে আমি কত সহস্র বার কখনও চিৎকার করে এই নির্জন বাড়িতে গেয়েছি, কখনও গাড়িতে বসে গুনগুনিয়ে, আর সবচেয়ে বেশি জনসমাজে বস্তৃত সেখানেই আমি সবচেয়ে বেশি একা, বর্জিতা, অসহায় শক্তিহীনা বলে নিজেকে অনুভব করি– নিঃশব্দে শুধু হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন নিয়ে।
***
নিঝুম নীরব সে গহ, বিরাট ভবন স্তব্ধ, বাইরের ভুবন তন্দ্রামগ্ন।
হয়তো এস্থলে আমার উচিত ছিল সহানুভূতি প্রকাশ করে জিগ্যেস করা শহর-ইয়ার কেন নিজেকে বর্জিতা অসহায় বলে মনে করেন। কিন্তু করলুম না।
সর্বনাশ! হঠাৎ বলে উঠলেন শহর-ইয়ার। তিনটে বেজে গেছে, আপনি ঘুমুন, আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। ছি ছি, আমার একেবারে কোনও কাণ্ডজ্ঞানই নেই!
.
০৬.
আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, সৃষ্টিকর্তা নারী-পুরুষ ভিন্ন ভিন্ন ধাতু দিয়ে গড়েছেন। শহর-ইয়ার ঘুমিয়েছে ক ঘণ্টা? তিন ঘণ্টা? সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি নিশ্চয়ই নয়। সাড়ে সাতটায় খাবার ঘরে চা খেতে এসে দেখি, তার চেহারা যেন শিশির-ধোয়া শিউলি ফুলটি। কোনও সন্দেহ নেই, সৃষ্টিকর্তা তাদের প্রতি বেশি মেহেরবান।
শহর-ইয়ার ডাক্তারের ব্রেকফাস্টের তদারকি করছে, সঙ্গে সঙ্গে তার লাঞ্চের জন্য স্যান্ডউইচ-সন্দেশ এটা-সেটা ছোট্ট টিফিনবক্সে সাজাচ্ছে এবং তারই ফাঁকে ফাঁকে বাজার-সরকারকে হাটের ফিরিস্তি বলে যাচ্ছে। আমাকে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বললে, আপনি দুপুরে, রাত্রে কী খাবেন যদি বলেন তবে এই বেলাই হাটের সঙ্গে সেগুলো এসে যাবে।
আমি বললাম, দোহাই আপনার! আমাকে নিষ্কৃতি দিন। আপনি তো দেখেছেন, আমি আমার বাড়িতে একেবারে একা। দিনের পর দিন কাঁচা, পাকা –সব বাজারের ফিরিস্তি বানানোর মতো একঘেয়ে মেয়েলি কাজ করতে হয় আমাকে। আমি ছুটি চাই।
কাজে বেরুবার পোশাক পরে ডাক্তার এলেন। ভালো ঘুম হয়েছে কি না শুধোলেন, সকালবেলা যে শুধু চা না খেয়ে এটা-সেটা খাওয়া উচিত সেটা শোনালেন এবং তার পর দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, আমার কপাল, তাছাড়া আর কী বলব। এশার নামাজ যেই না শেষ হয় অমনি সুলেমান বাদশার দুই জিন্ আমার দুই চোখের পাতার উপর তাদের আড়াইশো মণ ওজন নিয়ে হয় সওয়ার। আপ্রাণ চেষ্টা করে তখন পাঁচটি মিনিটও জেগে থাকতে পারিনে। সকালবেলা উঠেই বুকে পাপ-হিংসার উদয় হল– আপনারা দু জনাতে যে মজলিস জমালেন আমি তার হিস্যেদার হতে পারলুম না বলে।
আমি বললুম, আপনি বিশ্বাস করবেন যে আমি আপনাকে বার বার মিস্ করেছি।
ডাক্তার বললেন, কোথায় না সান্তনা পাব, শোকটা আমার আরও উথলে উঠছে।
শহর-ইয়ার সঙ্কোচের সঙ্গেই ডাক্তারকে বললেন, তা হলে আজ একটু বেলাবেলি বাড়ি ফিরলেই তো ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য খানিকক্ষণ সময় পাবে।
ডাক্তার সোৎসাহে বললেন, ঠিক বলেছ। আজ তা হলে গাড়ি সাতটার সময়ই পাঠিয়ে দিয়ো। আমাকে বললেন, গাড়ি আমাকে পৌঁছে দিয়েই ফেরত আসবে। আপনি যদি কোথাও যেতে চান তো কোনও অসুবিধে হবে না। এমনকি সাতটার সময় গাড়ি না পাঠাতে পারলেও আমার কোনও হাঙ্গামা হবে না। আমাদের দফতরে একটি হর-ফ-মৌলা, সকল-কাজের কাজি চাপরাসি আছে– জিনিয়াস লোকটা। এই কলকাতা শহরের একশো মাইল রেডিয়াসের ভিতরও যদি কুল্লে একখানা ট্যাসি খালি থাকে তবে সে সেটা পাবেই পাবে– যেন ব্লাডহাউন্ডের মতো সে ট্যাসির বদ বো শুঁকতে পায়।
আমি বললুম, আমি বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিই না; আমার কোনওপ্রকারের এনগেজমেন্ট নেই।
ডাক্তার বললেন, তা হলে তো আরও ভালো। শহর-ইয়ার আপনাকে নিয়ে যাবে এখানে-সেখানে, সর্বশেষে তার প্যারা প্যারা বইয়ের দোকানে। আর ইতোমধ্যে যদি ইচ্ছে হয়, তবে আমাদের পাঁচ-পুরুষের জমানো আরবি-ফারসি কেতাব ঘটতে পারেন আমাদের লাইব্রেরিতে– একপাশে আছে, আমার কেনা কিছু ইংরেজি আর বাঙলা বই। না, না, না। তওবা! ডাক্তারি বই এখানে থাকবে কেন?