বললুম, ভুলে গিয়েছি!
হাসলেন। শুধালেন, এবারে কী বাজাব?
ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে বললুম, ঐ মরণের সাগর পারে, চুপেচুপে তুমি এলে।
সঙ্গে সঙ্গে একদম ডেড় স্টপ। তার পর আমার হাতের কাছে খাটের বাজুতে বসে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার পর অতি ধীরে ধীরে বললেন, এই বারে আমার মনের অন্ধকারতম কোণেও আর কোনও সন্দেহ রইল না যে আপনার-আমার রুচি এমনই অস্বাভাবিক ধরনের এক যে, আর কেউ জানতে পারলে বলবে, আমি আপনার অন্ধ ভক্ত বলে আমার রুচি আপনার রুচির কার্বনকপি মাত্র। অথচ কী আর বলব, এ গান আমাকে যেরকম আত্মহারা করে দেয় অন্য কোনও গান সে-রকম পারে না। জানেন, এ গান কিন্তু এখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সমঝদারদের ভিতরও অতি, অতি দৈবে-সৈবে গাওয়া হয়। এবং যে দু বার শুনেছি সে-ও একদম বাইরের অজানা অচেনা গাওয়াইয়া গেয়েছে– অর্থাৎ সমঝদারদের চেলাচেলির কেউ না। আমার তো বিস্ময় বোধ হয়, রেকর্ড কোম্পানি কোন সাহসে এ গানটি বাছাই করল! দিনু বাবুর চাপের দরুন না কি?
আর কী অদ্ভুত সাহস দেখিয়েছেন আপনার গুরুদেব এই গানে।
ভুবন-মোহন স্বপন রূপে– কী বস্তাপচা সমাস এই ভুবনমোহন-টা। কোনও মেয়ের নাম ভুবনমোহিনী শুনলেই তো আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে জগদম্বা, রক্ষাকালী, ক্ষান্তমণি! না? অথচ এই গানের ঠিক এ জায়গাটায় সমাসটা শুনে নিজের কানটাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না যে, এই ঝুলি-ঝাড়া, সাতান্ন ঘাটের জল খাওয়া, হেকর্নিড়, ক্লিশে সমাসটি এত মধু ধরে, তার এত বৈভব, এত গৌরব! সঙ্গে সঙ্গে আমার বন্ধ চোখের তারা দুটি যেন আকাশের দিকে ধাওয়া করে– নইলে সমস্ত ভুবন কীভাবে মোহন হল সেটা দেখবে কী করে অনেকখানি উঁচুতে না উঠে, সেখান থেকে নিচের দিকে, ভুবনের দিকে না তাকিয়ে! আর তার পর? ওই ঊর্ধ্বলোক থেকে যখন বিশ্বভুবনের মোহনীয়া রূপ বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে আস্বাদন করছি তখন অকস্মাৎ কী নিদারুণ গভীর গহ্বরে পতন! শুনি,
বন্ধ ছিলাম এই জীবনের অন্ধকূপে—
আমার চোখের সামনে তখন কী বীভত্স দৃশ্য ভেসে ওঠে, জানেন! আমাদের গ্রামাঞ্চলের লোক এখনও বিশ্বাস করে, কোনও কোনও বিরাট ধনের মালিক তার সমস্ত ধন কোনও এক গভীর অন্ধকার গহ্বরে পুঁতে রেখে যায়, এবং সেটাকে পাহারা দেবার জন্য চুরি-করে-আনা একটি আট বছরের শিশুকে জন্মের মতো শেষবার তাকে ভালো করে খাইয়েদাইয়ে, সাজিয়েগুজিয়ে সেই ধনের পাশে বসিয়ে গুহা-গহ্বর বাইরের থেকে সিল করে দেয়। আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাই, সেই ক্ষুদ্র বালকটি যেন অন্ধভাবে ধীরে ধীরে আপনার অবস্থা হৃদয়ঙ্গম করছে। তার পর অনুনয়-বিনয়, তার পর রোদন; সর্বশেষে তার ক্ষুদ্র মুষ্টি দিয়ে চতুর্দিকের দেয়ালে আঘাতের পর আঘাত
আমি বললুম, দয়া করে ক্ষান্ত দিন, আমি আর শুনতে চাইনে।
বললেন, তবে থাক! ওই যে বন্ধ ছিলাম অন্ধকূপে–আমাদের প্রত্যেকের জীবন কি তাই নয়? অন্ধকূপের দেয়ালে জীবনভর করে যাচ্ছি মুষ্ট্যাঘাত আর আর্তনাদ, ওগো খোলো খোলো, আমাকে আলোবাতাসে বেরুতে দাও।
তার পর ভুবনমোহন রূপ নিয়ে মৃত্যু এসে দেয় নিষ্কৃতি– সে শ্যামসমান মোহনীয়া। এ কী ভ্রান্ত ধারণা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে যে মৃত্যু বিকট বীভৎস! সে আসা মাত্রই ঊর্ধ্বপানে তাকিয়ে দেখি, আকাশে স্তরে স্তরে সন্ধ্যাদীপের প্রদীপ জ্বালা –কত না নক্ষত্র স্তরে স্তরে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রতীক্ষা করছে আমাকে অমর্ত্যলোকের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে বলে, আর পদপ্রান্তে যে মর্ত্যভূমি থেকে বিদায় নিচ্ছি সেখানে ঝিল্লি-সঙ্গীতের সঙ্গে পুষ্পবনের গন্ধরূপে সৌরভ।
আপনাকে শুধোই, আপনি বয়সে বড়, অনেক কিছু পড়বার, শোনবার সুযোগ পেয়েছেন– এরকম আরেকখানা গান কেউ কখনও রচতে পেরেছে।
আমি বললুম, না, কিন্তু আপনি যেরকম গানটিকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছেন, কজন বাঙালি পারে সেটা?
শহর-ইয়ার অনেকক্ষণ ধরে সমুখপানে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। শেষটায় বললেন, ঠিক কোনদিক দিয়ে আরম্ভ করব বুঝতে পারছিনে। আমি যে গানটিকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছি তার জন্য আমার হৃদয় ছিল প্রস্তুত। কিন্তু সে প্রতিটি নির্মিত হল কী প্রকারে? রবীন্দ্রনাথের গানে গানে। ভিলেজ ইডিয়টেরও হৃদয় আছে কিন্তু সেই আকারহীন পিণ্ড সারাজীবন ধরে একই পিণ্ড থেকে যায়। আমার হৃদয় প্রতি নতুন গানের সামনে নতুন আকার ধরেছে, যেন সে শিল্পীর হাতের কাদা। ওই চিন্ময় গান শুনতে শুনতে আমার হৃদয় যেন ওই গানেরই মৃন্ময় রূপ ধারণ করে একটি মূর্তিরূপ ধারণ করে। গানটি যেন শিল্পী। গানের প্রতিটি সুর প্রতিটি শব্দ তার আঙুলের চাপ। সুরে সুরে শব্দে শব্দে অর্থাৎ গান-শিল্পীর আঙুলের চাপে চাপে মূর্তিটি সম্পূর্ণ হয়েছে। তার পর শুনলুম আরেকটি গান। আগের মূর্তিটি তনুহূর্তেই আবার শিল্পীর হাতে কাদাতে পরিবর্তিত হয়েছে। সুরে সুরে শব্দে শব্দে আবার সে এক নবীন মৃন্ময় মূর্তিতে পরিণত হল। এভাবে আমার হৃদয় কতশত মূর্তিতে পরিণত হয়েছে কতশত গানে গানে। আর এখন? এখন চেনা গানের দুটি শব্দ শোনা মাত্রই সম্পূর্ণ মূর্তি আপনার থেকেই তার আকার, তার রূপ নিয়ে নেয়। অথবা অন্য তুলনা দিয়ে বলব, রবীন্দ্রনাথের প্রত্যেকটি গান যেন ভিন্ন আকারের রঙিন এক পানপাত্র, আর আমার হৃদয় বর্ণহীন তরল দ্রব্য। ওই গানের পাত্রে প্রবেশ করে সে নেয় তার আকার, তার রঙ।