এমন সময় হুঙ্কার শোনা গেল, এই যে আলী সায়েব, চললেন কোথায়? এবং সঙ্গে সঙ্গে মালপত্রসহ রেলের মজুমদারের প্রবেশ। আমি ভালোমন্দ কিছু বলার পূর্বেই ফের প্রশ্ন, তার পর? শবনম কীরকম কাটছে?
এর পর যা ঘটল সেটা অবিশ্বাস্য না হলেও আমার জীবনে ইতোপূর্বে কখনও ঘটেনি। সেই অন্য প্রান্তের যুবতীটি হরিণীর মতো ছুটে এসে, আমার আরে করেন কী, করেন কী, থামুন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, মুসলমানি কায়দায় পা ছুঁয়ে সেলাম করে বাঙ্কের উপর উঠে বসলেন আমার মুখোমুখি হয়ে। ঠিক যেরকম গুরু-শিষ্য পদ্মাসীন হয়ে মুখোমুখি হয়ে বসেন। কারণ, একটু আরাম করার জন্য আমি ইতোপূর্বে বাঙ্কের হাতলটাকে হেলান বানিয়ে বসেছিলুম হাফ-পদ্মাসনে। যুবতী যেভাবে আসন নিলেন। তাতে আমাদের একে অন্যের হাঁটুতে হাঁটুতে আধ ইঞ্চিরও ব্যবধান নয়। এবং সমস্ত অভিযানটি তিনি সম্পূর্ণ করলেন, মজুমদার, তাঁর মালবাহী-কুলি, দু একজন প্যাসেঞ্জার যাঁরা ভাঁড়ের চায়েতেই সন্তুষ্ট হয়ে ইতোমধ্যে গাড়িতে উঠে পড়েছেন– এঁদের সকলের ব্যুহ অবহেলে ভেদ করে।
হার্ড-বয়েলড মজুমদারও যে বেকুবের মতো তাকাতে পারে এটা আমি জানতুম না। আমার কথা বাদ দেওয়া যেতে পারে। আমি যে বেকুব সে আমি চার বছর বয়েস থেকে বড়দার মুখে শুনেছি; এখনও শুনি।
যুবতী একবার শুধু বাইরের দিকে তাকিয়ে বেশ উচ্চ কণ্ঠে ডাকলেন, ওগো, এদিকে এসো– আমাদের আলী সাহেব! আমাকে শুধু বললেন, বে-আদবি মাফ করবেন, আমি প্রথমটায় ঠিক চিনতে পারিনি। ব্যস্ তখনকার মতো আর কিছু না। আমি তো মুঠোর মধ্যে এসে গিয়েছি– বাদবাকি ধীরেসুস্থে হবে।
ইতোমধ্যে ওই ‘ওগো’টি, এবং আর পাঁচজনও কামরায় ঢুকলেন। যুবতীর আদেশে তিনি তাঁর পরিচয় দিলেন। ডা. জুলফিকার আলী খান। যেমন দেবী তেমন দেবা নন। ভদ্রলোক বরঞ্চ একটু মুখ-চোরা। শুধু একটু খুশিমুখে বললেন, ইনি আপনার প্রকৃত ভক্ত পাঠিকা। দেবী মুখঝামটা দিলেন, আর তুমি বুঝি না? ভদ্রলোক কোনও গতিকে জান বাঁচিয়ে কামরার অন্য কোণের দিকে পাড়ি দিলেন।
নিজের অপ্রতিভ ভাব কাটাবার জন্য আমি যুবতীর সঙ্গে মজুমদারের আলাপ করিয়ে দিলুম। বাঁ হাত দিয়ে ঘোমটাটি তোলার একটুখানি ইঙ্গিত দিয়ে বললেন, আপনাকে বহুত শুকরিয়া। শবনম বিবিকে এ কামরায় দাওয়াত না করলে আমি তার স্বামীকে পুরোপুরি চিনে নিতে পারতুম না।
সেই বর্ধমান থেকে দক্ষিণেশ্বর অবধি বেগম খান কী কী প্রশ্ন শুধিয়েছিলেন, তার আপন মনের কথা কী কী বলেছিলেন তার পুরো বয়ান কেন, নির্যাস দেওয়াও আমার তাগতের বাইরে। গোড়ার দিকে তো তার কোনও কথাই আমার কানে ঢুকছিল না। বেচারি ডা. খান যে বেশকিছুটা অপ্রতিভ হয়েছেন সে তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বিশেষত দেবীর বসার ধরনটা। আমার দু হাঁটুর সঙ্গে তাঁর দু হাঁটু ছুঁইয়ে দিয়ে, আমাকে শব্দার্থে কোণঠাসা করে– আমিই-বা করি কী, নড়তে গেলেই যে হাঁটুতে গোত্তা লাগবে আসন না নিয়ে যদি ভদ্রস্থতার দূরত্ব বজায় রেখে স্কুল-গার্লটির মতো ব্রীড়াভরা ব্যবহার করত তা হলে তো ওদিকে আর কারও দৃষ্টি আকৃষ্ট হত না। এ তো আকছারই হয়। গোড়াতেই আমি নিবেদন করিনি সব লেখকই বরাবর? সক্কলেরই কিছু-না-কিছু ভক্ত, অন্ধ স্তাবক থাকার কথা। তদুপরি এ মেয়ে মুসলমান। বাকি গাড়ি হিন্দু। অবশ্য আমাকে আর ওই হাফ-হিন্দু মোন্দারকে বাদ দিয়ে। হিন্দুদের ধারণা এবং সেটা হয়তো ভুল নয় যে, মুসলমান মেয়েরা মাত্রাধিক লাজুক (নইলে বোরকা পরতে যাবে কেন?) কিন্তু এখানে যে ঠিক তার উল্টোটা!
তা সে যাই হোক, গাড়ির সবাই সন্তান; তারা আমাদের দু জনকে আল্লার হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেদের নিয়ে পড়লেন। বেগম খান শুধু মাঝে মাঝে মজুমদারকে তাঁর বাক্য সমর্থনের জন্য বরাত দিচ্ছিলেন। সে-ও এতক্ষণে হালে পানি পেয়ে গিয়েছে বলে শুধু যে সায় দিচ্ছিল তাই নয়, মাঝে মাঝে খাসা টুইয়েও দিচ্ছিল। তখন আর বেগমকে পায় কে? একে ছিল নাচিয়ে বুড়ি, তায় পেল মৃদঙ্গের তাল! আমার মনে পড়ল মজুমদার কলেজ আমলে মেয়েদের নিয়ে মশকরা করে কবিতা লিখে রীতিমতো নটরিয়াস হয়েছিল। বাদরটার খাসলত তিরিশটি বচ্ছরেও বদলাল না!
আমি শুধু একটিবার বেগমকে শুধিয়েছিলুম, আচ্ছা মিসিস খান—
বাধা দিয়ে বললেন, আমার নাম শহর-ইয়ার– আরব্য রজনীর শহর-ইয়ার।
আচ্ছা, বেগম শহর–
না, শুধু শহর-ইয়ার।
আচ্ছা, শহর-ইয়ার, আপনি কি কখনও সত্যকার বড় লেখকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন– যেমন মনে করুন, পরশুরাম–
সত্যিকার, মিথ্যেকার জানিনে– আপনি বড় লেখক।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললুম, যাক। আমার কিন্তু সত্যি একবার দেখতে ইচ্ছে করে, কোনও গ্রেট লেখকের সঙ্গে পরিচিত হলে আপনি কী করেন। বোধ হয় কবিগুরু যে বর্ণনা দিয়েছেন,
অমল কমল চরণ কোমল চুমিনু বেদনা ভরে—
বেগম খান সঙ্গে সঙ্গে পদপূরণ করে বললে,
বাধা না মানিয়া ব্যাকুল অশ্রু পড়িতে লাগিল ঝরে।
আমি অবাক হয়ে ভাবলুম, এই কবিতাটি যে খুব পরিচিত তা নয়, তবু মেয়েটি এর সঙ্গে পরিচিত। এর কাছে কি তবে মুড়ি-মুড়কির একই দর!
এবারে আমি শক্ত কণ্ঠে বললুম, দেখুন, আপনি যদি আমার রচনা সম্বন্ধে আলোচনা বন্ধ না করেন, তবে আমি আর একটিমাত্র কথা বলব না।