শহর-ইয়ার দেখলুম গান শোনার সময় চোখ বন্ধ করে পাষাণ-মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন।
এখানেও সেই বোলপুর পদ্ধতি। দুটো গানের মাঝখানে দীর্ঘ অবকাশ দেন।
আমাকে শুধোলেন, এবারে আপনার পছন্দ কী?
আমি আমার কণ্ঠে পরিপূর্ণ আন্তরিকতা প্রকাশ করে বললুম, আমি এই রবীন্দ্রসঙ্গীতের শপথ নিয়ে বলছি, আপনার-আমার রুচি একই। আমার বাড়িতে আপনি বাছাই করে যেসব গান বাজিয়েছিলেন তার থেকেই আমার এ দৃঢ় প্রত্যয় হয়েছে।
বললেন, মুশকিলে ফেললেন। আমি যখন নিতান্ত নিজের জন্যও বাছাই করি তখনও আমার এক যুগ কেটে যায় একটা রেকর্ড বাছাই করতে। তার পর রেডিয়োগ্রামের দিকে যেতে যেতে আপন মনে বললেন, হুঃ! তারও দাওয়াই বের করেছি। কাল আমি শুয়ে থাকব পাটরানির মতো আর এই পীরের সন্তানকে বলব রেকর্ড বাজিয়ে গানের সূত্রপাত করে পাপ সঞ্চয় করুন তিনি।
এবার বাজালেন, তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে কত আর সেতু বাঁধি।
তার মোহভঙ্গ হওয়ার পর যখন আমার কাছে এসে বসলেন তখন আমি তাকে শুধালুম, আপনার আত্মার খাদ্য কী?
আরও বুঝিয়ে বলুন।
দেহ ছাড়া আছে মানুষের মন, হৃদয়, আত্মা। আপনার বেলা এঁরা পরিতৃপ্ত হন কী পেলে? যেমন মনে করুন, সাহিত্যচর্চা, নাট্যদর্শন, সঙ্গীতশ্রবণ– এমনকি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিরীক্ষণ, বা যেমন আপনার স্বামীর বেলা সৃষ্টিকর্তার আরাধনা, কিংবা
বাধা দিয়ে বললেন, এবারে বুঝেছি এবং তার পর উত্তর দিতে আমাকে আদপেই বাছ-বিচার করতে হবে না, একলহমা চিন্তা করতে হবে না। আমার জীবন-রস রবীন্দ্রসঙ্গীত। ওই একটিমাত্র জিনিস।
আমি বললুম, ব্যস্?
ব্যস।
এবারে বাজালেন, আমার নয়ন—
কাছে এলে ফের শুধালুম, রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া আর কী?
বললেন, এর অনেক, অনেক পরে আসে যেসব জিনিস সেগুলোর মধ্যে একাধিক জিনিস আমাকে আনন্দ দেয়, মুগ্ধ করে, সম্মোহিত করে, আত্মবিস্মৃত করে, কিন্তু এরা আমার প্রাণরস নয়।
সেগুলো কী?
যেমন ধরুন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, শরচ্চাটুয্যের বড় গল্প, আপনার শবৃন–
আমি বললুম, থাক্, থাক্। এ নামগুলো আর কখনও এক নিশ্বাসে করবেন না। লোকে বলবে, আপনার বসবোধ অদ্ভুত, বিজারু, গ্রেটেস্ক।
বলুক। আমি কুমারস্বামী নই, স্টেলা ক্ৰামরিশও হতে চাইনে।
এবারে বাজালেন আরও একটা আমার প্রিয় গান।
ফিরে এসে আমার পায়ের কাছে বসলেন। আমি লম্বা হয়ে শুয়ে উত্তম যন্ত্রে, সমঝদার কর্তৃক সযত্নে বাজানো বে-জখমি রেকর্ড শুনছিলুম- পরম পরিতৃপ্তি ও শান্তিলাভ করে আমি যেন আমার সর্ব দেহ-মন কোনও এক মন্দাকিনী ধারায় ভাসিয়ে দিয়েছি। মৃদুকণ্ঠে বললে, আপনার পা টিপে দিই?
আমি সর্পাহতবৎ লাফ দিয়ে উঠে খাড়া হয়ে বসে বললুম, এ আবার কী?
দেখি, তাঁর মুখ থেকে সর্বশেষ রক্তবিন্দু অন্তর্ধান করেছে। আমার দিকে তাকালেন না, দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে চুপ করে বসে আছেন।
আমি তখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি, ভুল আমারই, উত্তেজিত হওয়াটা আমার গাইয়া বেকুবি হয়েছে। সেটা ঢাকবার জন্য রেডিয়োগ্রামের কাছে গিয়ে না দেখে-চেয়ে আগের রেকর্ডটার উল্টো পিঠটা বাজাবার চেষ্টা করলুম কিন্তু মেসিনটা এমনই নতুন মডেলের যে কোন বোতাম টিপলে কী হয়, কোন সুর কী ফানকশন অনুমান না করতে পেরে ভ্যাবাচ্যাকার মতো দাঁড়িয়ে রইলুম। শহর-ইয়ার বুঝতে পেরে কাছে এসে বললেন– আল্লাকে শুক্র, ভঁর গলায় কণামাত্র উত্তাপ বা অভিমান নেই- এখন আমি বাজাই। কাল আপনাকে দেখিয়ে দেব। তা হলে আপনার ইচ্ছেমতো যখন খুশি তখন বাজাতে পারবেন। তাই এই ঘরটাতেই আপনার থাকার ব্যবস্থা করেছিলুম। কথাগুলো শুনে লজ্জায় আমার যেন মাথাকাটা গেল। এ মেয়ের অনেক গুণ প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই লক্ষ করেছি কিন্তু সে যে এতখানি দয়ালু আর ক্ষমাশীলা সেটা লক্ষ করে যেমন লজ্জা পেলুম তেমনি আনন্দও হল যে এমন সদ্গুণ শুধু যে পৃথিবী থেকে অন্তর্ধান করেনি তাই নয়, আমারই এক পরিচিতার ভিতর পরিপূর্ণ মাত্রায় রয়েছে।
রেকর্ড চালু করে দিয়ে এবারে শহর-ইয়ার চেয়ারে বসলেন। আমি ততক্ষণে বিছানায় আবার লম্বা হয়েছি।
বললুম, শহর-ইয়ার।
জি?
আগে যেখানে বসেছিলেন সেইখানেই এসে বসুন।
জি, বলে এসে বসল।
আমি বললুম, টিপতে হবে না, হাত বুলিয়ে দিন। এবারে তাঁর মুখ আগের মতোই উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
আমি বললুম, আমি বড়ই মূৰ্থ। মনে আছে আপনারা দু জনা যখন বোলপুরে আসেন তখন প্রথম পাঁচ মিনিটের ভিতরই আমি বলেছিলুম, এদেশে আমার আত্মজন নেই? তখন লক্ষ করেছিলুম, আপনার চোখ ছলছল করেছিল। তার পরও দেখুন দেখি, আমি কত বড় বেকুব।
শহর-ইয়ার হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, থা না। এই সামান্য জিনিস নিয়ে
আমি বাধা দিয়ে বললুম, আমি কত বেকুব দেখুন। আচ্ছা, কাল যদি আমার শক্ত ব্যামো হয়, তা হলে আপনিই তো আমার দেহমনের সম্পূর্ণ ভার নেবেন এবং নার্স যা করে তার চেয়েও বেশি করবেন। নয় কি? তবে আজ আমার এত লজ্জা কেন?
এবারে শহর-ইয়ার শিশিরবিন্দুটির মতো ঝলমল করে উঠল।
উঠে এসে আমার মুখের উপর তার হাত রেখে আদরে ভরা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, আপনাকে বলিনি আর কথা না বলতে। এই আপনার মুখ বন্ধ করলুম। দেখি, কী করে ফের কথা বলেন। আসলে আপনার যাতে এখানে কোনও অসুবিধা না হয় তাই কাটুকে আমি আপনার কী কী দরকার, আপনার ডেলি রুটিন কী এসব অনেক প্রশ্ন শুধিয়েছিলুম। কথায় কথায় সে বলল, আপনি গা টেপাতে ভালোবাসেন তাই। এবার সব ভুলে যান। হাত মুখ থেকে সরালেন।