তব সাথে, প্রিয়ে মরুভূমি গিয়ে
পথ ভুলে তবু মরি,
তোমারে ছাড়িয়া মসজিদে গিয়া
কী হবে মন্ত্র স্মরি!
আমি বললুম, এটা কি ডাক্তারের উচিত হল? পরিপূর্ণ সত্য একমাত্র আল্লার হাতে; আমাদের শুধু চেষ্টা তার কতখানি কাছে আসতে পারি। ডাক্তার কি ভাবছেন, তিনি যে মৌলানা এনে দেবেন কুরান শরিফ সম্বন্ধে তাঁর পরিপূর্ণ জ্ঞান আছে? আমি ডাক্তার হলে বলতুম, মোস্ট ওয়েলকাম্! তার পর একসঙ্গে পড়তে গিয়ে যদি আপনি দেখতেন যে ব্যাপারটা থ্রি-লেগড রেস হয়ে যাচ্ছে তখন চিন্তা করতুম, এখন তা হলে কী করা যায়? তার বদলে মৌলানা এনে লাভ? তিনি তো প্রথম ঝাড়া পাঁচটি বৎসর আপনাকে ব্যাকরণ কণ্ঠস্থ করাবেন, এবং তার পর? আপনি, ডাক্তার, আমি– আমরা কুরানে যা খুঁজি, মৌলানা তো সেটা খোঁজেন না। তাই দাঁড়াবে :
তৃষ্ণায় চাহিনু মোরা এক ঘটি জল
মৌলানা এনে দিল আধখানা বেল!
আপনি ডাক্তারের প্রস্তাব না মেনে বেশ করেছেন। কিন্তু ডাক্তারের কথা ওঠাতে মনে পড়লো, বেচারী সমস্ত দিন খেটেছে, আপনার সঙ্গে দু চারটে কথা বললে তার শরীর-মন জুড়োবে। আপনি যান না।
শহর-ইয়ারের সে কী খিলখিল হাসি। হাসতে হাসতে যেন চোখে জল দেখা গেল। বললে, ইয়া আল্লা! আপনি আছেন কোন ভবে। এশার নামাজ সেরে বালিশের উপর ভালো করে মাথাটি রাখার আগেই তো তার আগের থেকে তৈরি পরিপাটি নিদ্রাটি আরম্ভ হয়ে যায়। যেন যন্ত্রটি হাতে নিয়েই সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বাজনা- আলাপ না, বিলম্বিত না, আর যন্ত্রটা বাধার তো কথাই ওঠে না। আর হপ্তায় কদিন আল্লায় মালুম, শুতে গিয়ে দেখি তিনি নামাজ সেরে জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। খাটে উঠবার আর তর সয়নি। আর সে কী ঘুম, কী ঘুম! অত্যন্ত নিষ্পাপ মানুষ ভিন্ন অন্য লোক বোধ হয় আল্লার কাছ থেকে এ ইনামটি পায় না।
আমি শুধালুম, এ বাড়িতে আপনার সঙ্গীসাথী কেউ আছে?
অবাক হয়ে বললেন, এ বাড়িতে?
হ্যাঁ।
বললেন, এ বাড়িতে তো আমরা দু জন থাকি। সঙ্গীসাথী আসবে কোত্থেকে?
এবার আমার আশ্চর্য হবার পালা। শুধালুম, এই যে গণ্ডায় গণ্ডায় সাজানো গোছানো। ঘর পেরিয়ে এলুম।
কেউ থাকে না তো।
ওই যে উইংটা– এল শেপের মতো এসে লেগেছে?
সেখানেই-বা থাকবে কে? ওখানে তো আলোই জ্বালানো হয় না।
নিচের তলায়, তেতলায়?
সেগুলোও তো অন্ধকার দেখলেন। কেউ থাকে না উপরে নিচে। থাকি আমরা দু জনে আর যে কটি লোক দেখলেন, আমরা যখন গাড়ি থেকে নামলুম।
আমি বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললুম, এই বিরাট বাড়িতে মাত্র দু জন লোক!
শহর-ইয়ার একটু বিষণ্ণ হাসি হেসে বললেন, আপনার ভয় করছে? কিন্তু এটা ভুতুড়ে বাড়ি নয়, রহস্য উপন্যাসের অভিশপ্ত পুরীও নয়। যিনি এ বাড়ি বানিয়েছিলেন সে ক যুগের কথা আমি জানিনে– তার পরিবার, ইষ্টকুটুমগুষ্টি নিয়ে এ বাড়িটাও নাকি যথেষ্ট বড় ছিল না। কিন্তু আমি সত্যি বিশেষ কিছু জানিনে। উনিও যে খুব বেশি কিছু জানেন, তা-ও তো মনে হয় না! ওঁকে জিগ্যেস করবেন নিঃসঙ্কোচে। এ বংশের, এ বাড়ির কোনও গোপন রহস্য নেই, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তার পর একটু ভেবে বললেন, আর উনিই-বা বলবেন কী? সেই খুদায় মালুম কশ লোকের পরিবার কমতে কমতে মাত্র একজনাতে এসে ঠেকল তারই তো ইতিহাস? আমার মনে হয় না, তিনি খুব বেশি কিছু একটা জানেন আর এ বাবদে তার কোনও কৌতূহলও নেই। তাতেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কত বিরাট বিরাট পরিবার প্রতিদিন বল ক্ষীণ আয়ুহীন হয়ে ক্ষয় পেয়ে যাচ্ছে, অতীতে গেছে, ভবিষ্যতেও যাবে। এতে বৈচিত্রই-বা কী, আর রোমান্সই-বা কোথায়? আর, এ তো শুধু একটা পরিবার। কত জাতকে জাত কত নেশনকে নেশন পৃথিবীর উপর থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে মুছে গেছে, তারই-বা খবর রাখে কে?
আমি বললুম, থাক্ এসব দুঃখের কথা। আমি এখানে রোমান্সের সন্ধানে আসিনি সে তো আপনি জানেন। এবারে বেশ মোলায়েম, মধুর, দিল-চসপ কোনও একটি বিষয়বস্তুর অবতারণা করুন। আপনার নামের মিতা বাগদাদের শহর-ইয়ার শহর-জাদী এক হাজার এক রাত্রি গল্প বলেছিলেন। আপনি নাহয় হাজারের শেষের এক রাত্রি সেইটে আরম্ভ করুন, বা শেষ করুন।
শহর-ইয়ার বললেন, যবে থেকে এখানে এসেছেন, সেই থেকে তো আমি সুযোগ খুঁজছি।
আমি বললুম, মাফ করে দেবেন।
তিনি বললেন, আপনার দোষ কে বলল? বলছিলুম কী, আমারও রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ডের একটি মামুলি সঞ্চয়ন আছে। দু একখানা শুনবেন?
নিশ্চয়ই, একশো বার এবং ধরে নিচ্ছি ডাক্তারের বিধিদত্ত যোগনিদ্রা তাতে ব্যাহত হবে না।
আশ্চর্য, আমার শোবারঘরের দেয়ালে শহর-ইয়ার বোতাম টিপে একটা ঢাকনা চিত করালেন। ভিতরের ক্যাবিনেট বা কুলুঙ্গি থেকে যেন রেললাইনের উপর দিয়ে প্লাইড় করে বেরোল একটি রেডিয়োগ্রাম। এ না-হয় বুঝলুম, কিন্তু ঘরের পশ্চিম প্রান্তের এসপারউসপার জোড়া দেয়ালে বিল্ট-ইন্ দেরাজের স্লাইডিং দরজাগুলো যখন এদিক ওদিক সরাতে আরম্ভ করলেন তখন তার মামুলি সঞ্চয়ন দেখে আমি বাঙাল– জীবনে এই দ্বিতীয়বার হাইকোর্ট দেখলুম। দশবিশ বছর ধরে প্রত্যেকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড না কিনলে তো এ রকম বিরাট সঞ্চয়ন হয় না। এবং খাস মার্কিন স্টাইলে সেগুলো কার্ড ইনডেকসিং পদ্ধতিতে সাজানো। গোটা ছয় কার্ডশেল আমার সামনের টেবিলে রেখে বললেন, ক্যাটালগ দেখতে চান তো এই রইল। আমার নিজের দরকার নেই। আমার মুখস্থ আছে। আরেকটা কথা, এ সঞ্চয়নের অনেক out of print রেকর্ড কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে পুরনো রেকর্ড নতুনের দামে কেনা। তার পর আমাকে কিছু জিগ্যেস না করেই লাগালেন, কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুম চয়নে– এ গানটা যেন আমাদের উভয় পক্ষের সম্মিলিত বিসমিল্লা আল্লার নামে আরম্ভ করি-র মতো।