আমি বললুম, শত যুগের তপস্যা-ফপস্যা জানিনে, ডাক্তার, কিন্তু আপনি যে রত্নটি পেয়েছেন সেটি অতিশয় কপালি লোকেও পায় কি না-পায় সন্দেহ। আর আমার জান্-কলিজা-দিল থেকে দোওয়া আসছে, আপনারা যেন একে অন্যের অক্লান্ত কদর দিতে দিতে দীর্ঘ, অতি দীর্ঘ, দরাজের চেয়েও দরাজ জীবনযাপন করেন। আমেন!
ডাক্তার বললেন, আমার সব মুরুব্বিজন ওপারে। এপারে মাত্র একজন– আপনি। আল্লা যেন আপনাকে একশো বছরের জিন্দেগি দেন। আমেন, আমেন।
.
রুচিশ্রী অনাড়ম্বর খানা-খাওয়া শেষ হলে পর একটুখানি ইতিউতি করে ডাক্তার বললেন, আজকের মতো আমাকে মাফ করে দেবেন, স্যর? দিনভর বেদম খাটুনি গিয়েছে। আমার চোখ জড়িয়ে আসছে– ওদিকে আবার এশার নমাজ এখনও পড়া হয়নি।
আমি বললুম, নিশ্চয়, নিশ্চয়। কাল সকালে দেখা হবে তো? না আপনি লেবরেটরিতে গিয়ে সেখানে ফজরের নমাজ পড়েন? গুডনাইট, ডাক্তার। খুদা-হাফিজ!
ডাক্তার মাথা নিচু করে বললেন, গুডনাইট, স্যর। তার পর একটু থেমে বললেন, আপনি আসাতে আমি যে কী আনন্দ পেয়েছি
শহর-ইয়ার উঠে বললেন, আমি ঠিক দু মিনিটের ভিতর ফিরে আসছি।
ডাক্তার তারস্বরে প্রতিবাদ জানালেন। শহর-ইয়ার সেদিকে কান না দিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলেন।
আমি শোবার ঘরে এসে ধীরেসুস্থে কাপড় ছেড়ে সবে একখানা বই নিয়ে বসেছি এমন সময় ম্যাডাম এসে উপস্থিত। যেন মাফ চেয়ে বললেন, ওঁর নামাজের ব্যবস্থাটা আমি নিজের হাতে করে দিই। ওই একটি ব্যাপারে, সত্যি বলছি ওই একটি মাত্র ব্যাপারে উনি সহজে সন্তুষ্ট হন না। আর-সবাই তো বছরের পর বছর একই জায়নামাজে নামাজ সেরে সেটি ভাজ করে রেখে দেয়, পরের বারের জন্য? উনি বললেন, উঁহু কত ধুলোবালি ময়লা জমে তার উপরে। তাই তার প্লেন লংক্লথের তিনখানা জায়নামাজ আমি পালাক্রমে রোজ রাত্রে কেচে রাখি। উনি অবশ্য বলেছিলেন, বেয়ারা কাচুক না। কিন্তু আমি জানি, আমার হাতে কাঁচা জায়নামাজে তিনি প্রসন্নতর চিত্তে নামাজ পড়েন।
আমি ঈষৎ বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই এশার নামাজের কথা শুনে। এবারে পুরো মাত্রায়। শুধালুম, উনি কি নামাজ-রোজাতে খুব আসক্ত? তাই তো মনে হচ্ছে।
শহর-ইয়ার বললেন, আসক্ত! ওই দুটি মাত্র ধাতু দিয়েই তো তাঁর জীবন গড়া। নামাজ-রোজা আর রিসার্চ।
আমি হাসতে হাসতে মাথা দোলাতে দোলাতে বললুম, আমি সব জানি, আমার কোনও জিনিস অজানা নেই। আমি পয়গম্বর হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়া আলাইহি সাল্লাম-এর বংশধর, তদুপরি আমি সাতিশয় সম্মানিত পীর খানদানের ছাওয়াল, তদুপরি আমার ঠাকুরদা দাদামশাই দু জনাই ছিলেন আঁহাবাজ মৌলানা। আমি জানব না তো কে জানবে? আপনি? ডাক্তার? আবাদ! হরগিজ নহি। বলে তিনটি আঙুল তুলে ঘন ঘন আন্দোলন করতে করতে বললুম, ট্রিনিটি, ট্রিনিটি- পিতা পরমেশ্বর, পুত্র ঈশ্বর এবং পবিত্র আত্মা। আপনি সেই পবিত্র আত্মা। আপনি সেই পবিত্র আত্মা– রূপকার্থে ও শব্দার্থে। কিংবা, ভদ্রে বেগমসাহেবা, কাছে এসে অম্মদ্দেশীয় গীতাটি স্মরণ করুন। জ্ঞানযোগ– সে ডাক্তারের রিসার্চ। কর্মযোগ– সে তাঁর আরাধনা ক্রিয়া-কর্ম। ভক্তিযোগ– সে আপনার প্রতি তাঁর অবিচল ভালোবাসা। আপনাদের উভয়ের এ জীবনে সুখ আছে এবং অন্যলোকে মোক্ষ-নজাৎ! অবশ্য দ্বিতীয়টা যেন একশো বছর পরে আসে। কারণ ফারসিতে বলে, দের আএদ, দুরুস্ত আদ– যেটা দের-এ অর্থাৎ দেরিতে আসে সেটাই দুরুস্ত–পরিপাটি হয়ে আসে।
আমার উৎসাহের বন্যায় শহর-ইয়ার ডুবু ডুবু। সাদা-মাটা ভাষায় বললেন, আপনার মুখে মধু, কানে মধু– এই যেন চিরকাল আপনার কিস্মতে থাকে। আর আপনার শুভেচ্ছা-দোয়ার জন্য আমার যা কর্তব্য কাল, শুক্রবার, সেটি করব। আপনার সলাম-কল্যাণের জন্য মহল্লার মসজিদে শিরনি পাঠাব। নমাজান্তে জমায়েত ধর্মনিষ্ঠজন আপনার আত্মার জন্য দোয়া করবেন।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললুম, বে-ফায়দা, বে-কার, ইয়ার! বে-ফায়দা, বেকার। আমার মতো পাষণ্ড পাপির জন্য শিরনি পাঠানো তপ্তকটাহে বিন্দুমাত্র বারিসিঞ্চনতুল্য। তা সে যাক আল্লাহ মেহেরবান, তাঁর কাছ থেকে শেষ বিচারের দিনে মাফের আশা রাখি। এবারে বলুন তো, নামাজ-রোজার প্রতি আপনার কীরকম টান?
দুঃখ করে বললেন, আমার বন্-নসিব। আল্লা আমাকে সেদিকে মতিগতি দেননি।
কর্তা অনুযোগ করেন না?
একদম না। ভদ্রলোক কখনও কাউকে কোনও জিনিস করতে বলেন না– ভালোও না, মন্দও না। এমনকি তার মডার্ন বন্ধুবান্ধবদের কেউ কেউ তাঁর আচারনিষ্ঠতা নিয়ে অল্পস্বল্প মেহসিক্ত কৌতুকের ইঙ্গিত করলে তিনি শুধু মিটমিটিয়ে হাসেন। শুধু তাই নয়, মাঝে মধ্যে ধর্ম নিয়ে তাদের ভিতর আলোচনা আরম্ভ হলে তিনি সবকিছু শোনেন মন দিয়ে, কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁরা তাঁকে কখনও সে আলোচনায় যোগ দেওয়াতে পারেননি। বিশ্বাস করবেন না, আমার সঙ্গে তো সব বিষয়েই কথাবার্তা হয়– আমার সঙ্গে পর্যন্ত তিনি কখনও ওই একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেননি, আমি সূত্রপাত করলেও না। এই দেখুন, রোববারে কাজে বেরোন না বলে ফজরের নামাজ পড়ে প্রথম এক ঘণ্টা কুরান পড়েন সুর করে কারীদের মতো। তার পর খানতিনেক ইংরেজি-বাংলা অনুবাদ আর একখানা আরবি টীকা নিয়ে আরেক ঘণ্টা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি শব্দের গভীরে গিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে নোট করে টোকেন। আমি তাকে একদিন ওই অধ্যয়নের দিকটা আমার সঙ্গে করতে অনুরোধ জানিয়েছিলুম। তিনি বললেন, আমি নিজে এতই অল্প জানি যে তোমাকে কপিটেন্টলি সাহায্য করার শক্তি আমার মধ্যে নেই। আমি বরং তোমার জন্য একজন ভালো মৌলানা যোগাড় করে দিচ্ছি। আমি বললুম, থাক। আপনিই তো কবি ওমর খৈয়ামের একটি চতুষ্পদী অনুবাদ করেছেন–