গাড়ি থেকে নেমে আগাপাশতলা তাকিয়ে দেখি বিরাট প্রকাণ্ড প্রাচীন যুগের একটা বাড়ি- বরঞ্চ ফরাসিতে বলা উচিত শাটো। ক্ষীণ আলোকিত আকাশের অনেকখানি ঢেকে রেখেছে বাড়িটা তার থেকেই অনুমান করলুম সেটার সাইজ। কারণ সমস্ত বাড়িটা অন্ধকার, অপ্রদীপ। শুধু দোতলার বৃহৎ একটা অংশের সারিবাধা অনেকগুলো জানালা দিয়ে বেরুচ্ছে যেন আলোর বন্যা। এ যুগেও যে কলকাতায় এরকম অতিকায় বসত-বাটি আছে সে ধারণা আমার ছিল না। বাড়িটা কিন্তু রাজামহারাজাদের কলকাতার ফ্যান্সি প্যালেস প্যাটার্নে তৈরি করা হয়নি। গাড়িবারান্দায় যে একটি আলো জ্বলছিল তারই আলোকে দেখলুম, অলঙ্কারবর্জিত সাদামাটা কিন্তু খুবই টেকসই দড় মাল-মশলা দিয়ে বাড়িটা তৈরি। পরিষ্কার বোঝা গেল যে যিনি বাড়িটা তৈরি করান তাঁর অসংখ্য ঘরকামরার দরকার ছিল বলে সেটাকে যতদূর সম্ভব বড় আকারের করে তৈরি করিয়েছিলেন এবং সেই সময় এটাও স্থির করেছিলেন যে তাঁর বংশধরগণকে যেন অন্তত দুশো বছর ধরে অন্য বাড়ি বানাবার প্রয়োজন না হয়।
দারওয়ানসহ জনা পাঁচেক লোক এগিয়ে এল। হঠাৎ নবাবদের উর্দি পরা লোকজনের হাফ মিলিটারি সেলুটাদির আশঙ্কা আমি করিনি। তারাও মুসলমানি কায়দায় অল্প ঝুঁকে সালাম জানাল। কোনও জায়গায় কোনও কৃত্রিমতা নেই। ডাক্তার কথা বলে যাচ্ছেন, ম্যাডাম মনে হল যেন ক্রমেই গম্ভীর হতে গম্ভীরতর হয়ে যাচ্ছেন। মুসাফিরির ক্লান্তিও হতে পারে।
বাড়ির বিপুল আকারের তুলনায় দোতলা যাবার সিঁড়ি যতখানি প্রশস্ত হওয়ার কথা ততখানি নয়, যদিও প্রয়োজনের চেয়েও বেশি।
কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেলুম যখন দোতলার একটা অতি দীর্ঘ বারান্দার উপর দিয়ে যেতে যেতে খোলা দরজা দিয়ে ডাইনের দিকে দেখি, একটার পর একটা মাঝারি সাইজের বেডরুম-ড্রইংরুম, মাঝে মাঝে ডাইনিংরুম– কখনও দিশি ধরনের, কখনও-বা বিলিতি স্টাইলের। দু একটা কামরা মনে হল যেন বাচ্চাদের পড়াশুনোর ঘর। বেডরুমগুলোর কোনওটাতে প্রাচীন দিনের জোড়া পালঙ্ক, কোনওটাতে ছোট ছোট তিনখানা তক্তপোশ। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য কোনও ঘরে একটিমাত্র জনপ্রাণী নেই, বিছানাপত্র কিন্তু ছিমছাম তৈরি আর প্রায় প্রত্যেকটি কামরায় বিজলিবাতি জ্বলছে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ডান দিকে মোড় নেবার সময় আমি আবার লক্ষ করেছিলুম, বাঁ দিকে এটারই মতো একটা দীর্ঘ উইঙ, রাইট এঙ্গেলে এটার সঙ্গে লেগে ইংরিজি এল শেপ তৈরি করেছে। সেটা কিন্তু অন্ধকার।
অবশেষে দীর্ঘ অভিযান শেষ করে আমরা একটা বড় সাইজের ড্রইংরুমে ঢুকলুম। আমাকে বসিয়ে বললেন, আমার বন্ধু-বান্ধবরা দেখা করতে এলে এখানেই বসেন; তারাই পছন্দ করে এটা বেছে নিয়েছেন। একটু পরেই আপনার ঘর দেখাচ্ছি– শহর-ইয়ার সেটা চেক-আপ করে নি। ঘরটা ভালো না লাগলে কাল আপনার খুশিমতো যে কোনও একটা পছন্দ করে নেবেন। বাঁ দিকে মাদামের বুদোওয়ার সমস্তটা দিন তিনি ওইখানেই কাটান। আর এই ডান দিকে আপনার ঘর–অন্তত এ রাত্রিটার মতো। চলুন, দেখি, কদ্দূর কী হল। শহর-ইয়ার আবার একটু অতিরিক্ত পিটপিটে, তায় আবার আপনার প্রতি তার হিমালয়ান ভক্তি।
অ। মাদাম একেবারে ন-সিকে বিলিতি। একটা চেয়ারে বসে তদারকি করছেন– বেয়ারাটা আমার দুটো সুটকেস থেকে জিনিসপত্র, জামাকাপড় বের করে ঠিক ঠিক জায়গায় রাখছে কি না। আমার দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন হাসি হেসে বললেন, বসুন, বসুন। আপনার বইপত্র, কাগজকলম পাশের ঘরে আপনার স্টাডিতে। অন্তরঙ্গ বন্ধু এবারে মুখে কৌতুকের হাসি, কিংবা বান্ধবী দেখা করতে এলে ওই স্টাডিতে নিরিবিলিতে তাঁকে এনটারটেন করতে পারবেন। আর এই এখানে বাথরুমের দরজা। হাতমুখ ধোবেন, না গোসল করবেন? আমি ছুট লাগাচ্ছি এখন, ডালভাতের তদারকি করতে। বেয়ারা এসে আপনাকে নিয়ে যাবে আমি বাসনবর্তন থেকে ফুৎ না পেলে। ডাক্তারকে শুধোলেন, হা গা, তুমি খেয়েদেয়ে পেটটান করে ফেলনি তো? ফের আমাকে বললেন, লেবরেটরি থেকে ফেরা মাত্রই উনি খাবার টেবিলের দিকে যে স্পিডে ধাওয়া করেন যে দেখে মনে হয়, বহু শত বৎসরের বিরহ কাটানোর পর মজনু প্রিয়া লাইলিকে দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু ভদ্রলোকের একটি অতিশয় মহৎ সদ্গুণ আছে– যেটি প্রতি যুগে প্রতি দেশে বিবাহিতা রমণী মাত্রই আপন পরম সৌভাগ্য বলে মনে করবে। হিন্দু হলে বলবে, না জানি কত শত যুগ তপস্যা করে এ-হেন বর পেলুম, আর আমি বলি আমার বহু মুরুব্বির বহু দিল্-এর দোওয়ার ফলে এ-হেন কর্তা পেয়েছি। সেই মহৎ সদ্গুণটি কী? খানা-টেবিলের পানে ধাওয়া করে সেখানে যদি দেখেন সে প্লেন একধামা মুড়ি, কিংবা পক্ষান্তরে যদি দেখেন কোর্মা-কালিয়া-মুসল্লম-কাবাব-পোলাও গয়রহ তখন এই সহৃদয় মহাজনের কাছে দুই পক্ষই বরাবর! আর না– আমি চললুম।
ডাক্তার খাটের বাজুতে বসে লাজুক হাসি হাসতে হাসতে বললেন, একেই তো বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলেন একখানা উয়েল-লুব্রিকেটেড রসনা ডাক্তার হিসেবে নিতান্ত হিউমেন এনাটমি জানি বলে একখানা রসনাই বললুম, ইতরজন বলবে শতাধিক তদুপরি আপনার সঙ্গে পরিচয়ের খুশকিম্মৎ নেক্-নসিব হওয়ার পর থেকে তার ওপর ভর করেছে একটা আস্ত সাহিত্যিক জলজ্যান্ত মামদো। আপনার সাহিত্যিক গুণটা পেলেও না হয় সেটা সয়ে নিতুম। তা নয়। রামকে না পেয়ে পেয়েছে তার খড়ম। এখন আমার ব্রহ্মতালুর উপর শুকনো সুপুরি রেখে অষ্টপ্রহর দমাদম পিটুনি সেই আপনি, রামচন্দ্রজি, আপনার খড়ম যে বরায়ে মেহেরবানি এনাম দিয়েছিলেন তাই দিয়ে। ওফ।