বর্ধমানে প্রায় সবাই চায়ের সন্ধানে প্ল্যাটফর্মে নামলেন। এঁরা হিন্দু না, এঁরা অপটিমিস্ট।
শহর-ইয়ারের পাশে গিয়ে বসে বললুম, শহর-ইয়ার, এখানে কিন্তু আপনি একমাত্র আমার ইয়ার।
মুখে স্মিতহাস্য ফুটিয়ে বললে, হ্যাঁ, এইখানেই আমাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু শুধু এখানে কেন, আপনি তো সর্বত্রই আমার একমাত্র ইয়ার।
আমি বললুম,
ঘোড়ায় আমার জুটিবে সওয়ার, ইয়ার পাইবে সাকি।
মানে?
আমি আপনার চেয়ে বয়সে ডবল না হলেও তারই কাছাকাছি। আমার পালে ওপার যাবার হাওয়া লাগে-লাগে। তখন আপনি, হে আমার সাকি, নতুন ইয়ার পাবেন।
রীতিমতো বেদনা-ভরা কণ্ঠে বললে, ছিঃ, আপনি এসব কথা বলেন কেন? ভাষার ওপর আপনার বিধিদত্ত অধিকার আছে। সেটা আপনার হাতে ধারালো তলওয়ার, সাবধানে ব্যবহার না করলে আমার মতো সরল জন, যে বিশ্বাস করে আপনার অতি কাছে এসেছে তার বুকের ভিতর তার ফলাটা হঠাৎ ঢুকে গিয়ে খামোকা রক্ত বওয়াবে না? আপনার কাছ থেকে আমার বহুৎ আশা, বহু বহু বৎসর আপনার সাহায্য আমি পাব বলে নিশ্চিত ধরে নিয়েছি।
আচ্ছা, শহর-ইয়ার, আপনি স্কুল-কলেজ গিয়েছেন, সে সূত্রে নিশ্চয়ই দু পাঁচজনের সঙ্গে আপনার আলাপ-পরিচয় হয়েছে। অন্তত কোনও কোনও অধ্যাপকের স্নেহ আপনি অতি অবশ্যই পেয়েছেন, কারণ আমি জানি আপনি পড়াশুনায় অসাধারণ ভালো ছিলেন, আপনার আদব-কায়দা মানুষকে নিশ্চিন্ত মনে মেলামেশার সুযোগ করে দেয়, এবং তদুপরি মুসলমান ছাত্রী এই দশ বছর আগে এতই বিরল ছিল যে হিন্দু অধ্যাপকরা তাদের বিশেষ আদরের চোখে দেখতেন– হয়তো-বা তাতে নতুনের প্রতি খানিকটে কৌতূহলও মেশানো থাকত। বিয়ের পরে আপনার স্বামীর ইয়ার-দোস্তের সঙ্গেও আপনার কিছুটা ঘনিষ্ঠতা না হয়ে যায় না। এদের ভিতর কেউ নেই যার সঙ্গ পেলে, যার সঙ্গে কথা বলে আপনি আনন্দ পান?
না। ব্যস, ওই একটি শব্দ। এত ক্ষুদ্র পরিষ্কার উত্তর আমাকে রীতিমতো হকচকিয়ে দিল।
কিন্তু– আমার আর কথা বলা হল না। প্রায় চিৎকার করে উঠলুম, এ আমি কী দেখছি! মরীচিকা, মরুতৃষা, মিরাজ? ভানুমতী, ইন্দ্রজাল? না, না, এসব কিছুই নয়। আমার চোখদুটো বিলকুল বরবাদ হয়ে গিয়েছে। ভাই শহর-ইয়ার, কলকাতায় নেমেই সোজা চশমার দোকান।
আমার উত্তেজনার কারণ সরল নয়, অতি কুটিল। বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি। সরকারি হুকুমে যখন সর্ব রেলওয়ে স্টেশনের মদের বার বন্ধ হয়ে গেল, তখন এই পুণ্যভূমি বর্ধমান স্টেশনের কেনার হয় ভেবেছিলেন চা, বিয়ার, হুইস্কি একই জিনিস, সবকটাই পৈশাচিক মাদকদ্রব্য, কিংবা চা মদ্য না হলেও উত্তেজক দ্রব্য তো বটে। অতএব কংগ্রেসের অকৃত্রিম সদস্য হিসেবে কংগ্রেস ধর্মানুযায়ী তারা মদ্যজাতীয় সর্বউত্তেজক আবর্জনার সঙ্গে চা-কেও কুলোর বাতাস দিয়ে তাড়িয়ে দেন। এ তত্ত্বটি আমি সাতিশয় বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হয়েছি। কেউ যদি সন্দেহ প্রকাশ করে, আমি তা হলে তাকে দেখে নেব– কী কী করব, এখন বলছিনে, কিন্তু সর্বপ্রথমেই যে আমি তার বিরুদ্ধে মানহানির মোকদ্দমা আনব সে-বিষয়ে আমি স্থিরনিশ্চয়।
এহেন দৃঢ় প্রত্যয় যখন আমার হৃদয়মনে দড় থানা গড়ে টাইট বসে আছে, তখন যদি বর্ধমান রেলকামরায় কেলনারের লোক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মনে রাখবেন, আমরা তাকে অর্ধেক রাজত্ব ও রাজকন্যা, কিংবা তার চেয়েও ভালো, বাস্-ট্যাক্সি পারমিটের প্রলোভন দেখাইনি আবার বলছি আপন খেয়াল-খুশি, মর্জিমোতাবেক, মেহেরবানি মাফিক একখানা ট্রেতে ঢাউস পট চা, রুটি-মমলেট সামনে ধরে সবিনয় বলে, মেমসায়েব, আপকি চা তবে কি আপনার নলেজ বাই ইনফারেন্স্ এই হবে না, যে আপনার চোখ আল্লার গজবে বিলকুল বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে? এ তো মাতালের সিঙ্গল বস্তু ডবল দেখা নয়। এ যে যা নেই তা দেখা, আকাশকুসুম শোঁকা, গাড়ির কামরার মধ্যিখানে রাজার পিসি কুমড়ো দিয়ে ক্রিকেট খেলতে খেলতে ফ্রেম থেকে খুলে আমসত্ত্ব ভাজা খাচ্ছেন তাই দেখা!
না, না, না। ইয়ার শহর-ইয়ার, এ সেই আরব্য রজনীর অন্-নশারের কাল্পনিক ডিনার! আমি এসব জিনিস স্পর্শ করার চেষ্টা করে হাওয়ার কোমরে রশি বাঁধনেওয়ালার মতো সমুখের বঙ্গীয় উন্মাদ আশ্রমের ওয়েটিং লিস্টে নাম লিখিয়ে বাদবাকি জীবন ঝুলে থাকতে চাইনে।
শহর-ইয়ার বললেন, আপনার হুঁশিয়ারি অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। তবে এ সম্পর্কে সামান্য একটি কথা আছে। আপনি যখন কাটুকে টাকা দিয়ে বাড়িঘর খবরদারির কথা বলছিলেন তখন আমি স্টেশনের লোককে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়ে ব্যবস্থাটা করিয়েছিলুম। এবারে খান।
ওহ্! এ খাওয়াতে ডবল সুখ! আর সবাই জান পানি করে পেয়েছে ভাড়ের পানি—না চা? সে একই কথা। আমি আগের সিটে ফিরে গেলুম না।
এবারে ডাক্তার গাফিলি করেননি কিংবা ভুলেও যাননি। তাঁর পিতার আমলের সেই ঢাউস পালকিগাড়ির মতো মোটর নিয়ে স্টেশনে হাজির। লক্ষ করলুম, ডাক্তারদের সামাজিক আচরণ যদিও আর পাঁচজন হিন্দুদেরই মতো, তবু বাড়ির বাইরে বিশেষ করে যেটাকে বলা হয় পাবলিক প্লেস সেখানে স্ত্রীর সামনে এখনও একটু আড়ষ্ট, যেন সবে পরশুদিন তাদের শাদি হয়েছে।
প্রথমটায় রাস্তার উপরকার দোকানপাট, দুটো-একটা গারাজ দেখে সেগুলোর পিছনে কী বস্তু আছে ঠিক অনুমান করতে পারিনি। মোড় নিয়ে খোলা গেটের ভিতর দিয়ে গাড়ি তখন সংকীর্ণ একটা গলিপানা প্যাসেজের ভিতর দিয়ে ঢুকছে।