মণির সেই প্রেম পরিপূর্ণভাবে অনুভব করেছিলুম আমি, কিন্তু তার প্রেমের আবেগ, সে প্রেমের ভিতর তার সম্মোহিত অবস্থা, যেন সে নিশির-ডাকে-পাওয়ার মতো চোখ বন্ধ করে ভিতরকার প্রেমের প্রদীপালোকে চলেছে দয়িতের অভিসারে কাবুলের শঙ্কাসঙ্কুল গিরিপর্বত লঙ্ঘন করে– এসব পারলুম না আপনাদের হৃদয়ে সঞ্চারিত করতে। জানেন তো, আমাদের কোনও কম ল্যানগুইজ ছিল না?– তৎসত্ত্বেও আমার হৃদয়ে মণির প্রতিটি হৃদস্পন্দন সঞ্চারিত হয়েছিল অব্যবহিত ভাবে।
আমার আফসোস, আফসোস– হাজার আফসোস– যে আমি মণির প্রেমের নেমক খেয়ে সে নেমকের কিম্মৎ দিতে পারলুম না আমার সবসময় মনে হয় আমি যেন নেমকহারাম রয়ে গেলুম। জানেন, মণির এই বেদনাকাহিনী লেখার পর সেটা আর কখনও পড়িনি? লেখার সময়ই আমি প্রতি লহমায় হৃদয় দিয়ে অনুভব করছিলুম, সুর লাগছে না, কিন্তু প্রাণপণ আশা করছিলুম যে সৃষ্টিকর্তা আমাদের নগণ্য সৃষ্টির চলার পথ তৈরি করে দেন তিনি কোনও এক মিরা অবতীর্ণ করে শেষরক্ষা করে দেবেন। কিন্তু আফসোস, তিনি প্রসন্ন হলেন না।
শহর-ইয়ার গভীর দরদ দিয়ে শুনছিল। শেষটায় বললে, মাফ করবেন, আমি আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলুম না। কিন্তু তবু জানতে ইচ্ছে করে, আপনার এই ধারণাটা জন্মাল কী করে?
অত্যধিক আত্মপ্রত্যয়, দম্ভ। আমি ভেবেছিলুম এ তো জলজ্যান্ত ঘটনা। কোনও-কিছু বাড়াতে-কমাতে হবে না। স্মৃতির গভীরে কলম ডোবাব আর লিখব। এতে তো কোনও মুশকিল নেই। সেই হল আমার কাল। আপন কল্পনা, সহানুভূতি বাদ পড়ে গেল– এককথায় আমার হৃদয়রক্তে রাঙা হয়ে রক্তশতদলের মতো মণি ফুটে উঠল। হয়ে গেল ফটোগ্রাফ সে-ও আবার রদ্দি ফটোগ্রাফ। ফোকাস ঢিলে, কোথাও না ওভার-একসপোজড, কোথাও-বা আন্ডার। ফ্ল্যাট, কন্টুর নেই আর ক্যামেরাও বাঁকা করে ধরা ছিল বলে টিলটেড়।
শহর-ইয়ার শব্দার্থে তামাম শহরের ইয়ার। ইনি আমার লেখার অকৃত্রিম ইয়ার। ঘন ঘন মাথা নেড়ে নেড়ে আমার বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাল।
০৫. স্টেশনে আমার পরিচিত
০৫.
স্টেশনে আমার পরিচিত দু চারজনের সঙ্গে দেখা। সবাই এক কামরায় উঠলুম– যদিও আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলুম, শহর-ইয়ারের এ ব্যবস্থাটা আদৌ মনঃপূত হয়নি। তাই আমি আরও বিশেষ করে ওদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলুম না।
শহর-ইয়ারকে অপূর্ব সুন্দরী বলা চলে না কিন্তু তার সৌন্দর্যে অপূর্বর্ত আছে। সে সৌন্দর্য তিনি ধারণ করেছেন অতিশয় সহজে, এমনকি অবহেলা-ভরে বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। পুরুষানুক্রমে বিত্তশালীজন যেরকম তার বৈভব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে ধনী-দরিদ্রের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে মেলামেশা করে। আমার মনে হচ্ছিল, একে একটুখানি লক্ষ করলেই বোঝা যাবে, ইনি সুন্দরী-কুলে জন্ম নিয়েছেন, সুন্দরীদের ভিতর বড় হয়েছেন, তাঁর সৌন্দর্য নিয়ে ছেলেবেলায় কেউ আদিখ্যেতা করেনি বলে তিনি এ বিষয়ে এমনই সহজ-সরল যে সৌন্দর্যহীনারা তার সৌন্দর্যকে ঈর্ষা করবে না, সুন্দরীরা তাকে প্রতিদ্বন্দিনীরূপে দেখবে না। তার সৌন্দর্যের অপূর্বতা কিছুটা তার বর্ণে। বংশানুক্রমে পর্দার আড়ালে বাস করার ফলে তাঁর শান্ত গৌর বর্ণকে অসূর্যম্পশ্যা বর্ণ নাম দেওয়া যেতে পারে। এ বর্ণ সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে অতি অবশ্য কিন্তু সকলেরই চিত্ত আকর্ষণ করবে সে-কথা বলা যায় না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে এ রঙের প্রতি আমার নাড়ির টান আছে আমার মা-বোন সকলেরই এই ধরনের রঙ- কেউ একটু বেশি গৌরী, কেউ-বা কম। তদুপরি শহর-ইয়ার এখন পূর্ণ যৌবনা অনুমান করলুম তাঁর বয়স পঁচিশ থেকে আটাশের কোনও জায়গায় হবে। মাথায় সিঁদুর থাকার কথা নয়, এবং যদিও বেশভূষা হুবহু বিবাহিতা বাঙালি হিন্দু মেয়ের মতো তবু কোথায় যেন, কেমন যেন একটা পার্থক্য রয়েছে। আমি কিছুতেই সে-পার্থক্যটা খুঁজে বের করতে পারলুম না। আমার এক অসাধারণ গুণী চিত্রকর বন্ধু আছেন এবং অদ্ভুত তাঁর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ শক্তি। তিনি থাকলে আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারতেন। পর্দানশিন খানদানি মুসলমান গৌরীদের রঙ তিনি লক্ষ করে আমার সামনে একদিন ওই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন।
পরিচিতেরা দু একবার তার দিকে আড়নয়নে তাকিয়েছিলেন– এ মেয়ে যে আর পাঁচটি সুন্দরী থেকে ভিন্ন সেটা হয়তো ওঁদের চোখেও ধরা পড়েছিল। শহর-ইয়ার কিন্তু সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নির্বিকার। কে বলবে, এঁর মা-দিদিমা যুগ যুগ ধরে পর্দার আড়ালে জীবন কাটানোর পর ইনিই প্রথম বেগানা পুরুষদের সামনে আত্মপ্রকাশ করেছেন।
কামরাটা সবচেয়ে বড় সাইজের যা হয়। তিনি কিন্তু আমার পাশে না বসে আসন নিলেন সুদূরতম প্রান্তে। বেঞ্চির উপর পা তুলে মুড়ে বসে, কিন্তু আমার দিকে মুখোমুখি হয়ে। আমাদের পাঁচজনের ভিতর নানারকম আলাপ-আলোচনা আরম্ভ হল। সকলেই বুদ্ধিজীবী বিষয়বস্তুর অনটন হওয়ার কথা নয়। শহর-ইয়ার সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছেন কি না, বুঝতে পারলুম না।
কবে হয়ে গিয়েছে এঁর বিয়ে, কিন্তু বাপের বাড়িতে বিয়ের পূর্বে মেয়েকে যে তালিম দেওয়া হয়– শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সে কীভাবে বসবে-চলবে এবং বিশেষ করে অঙ্গসঞ্চালন নিরোধ করে থাকবে সেটা মোটেই অনভ্যাসবশত বিস্মৃত হয়নি। সেই যে বোলপুরে যেভাবে আসন নিয়েছিল বর্ধমান পর্যন্ত তার সামান্যতম নড়চড় হল না।