কিন্তু বরপক্ষ কনে না নিয়ে শুধু হাতে যদি বাড়ি ফেরে তবে সারা রাস্তা ধরে তাদের শুনতে হবে পাঁচখানা গাঁয়ের টিটকারি। তার ব্যবস্থাও চাচা করে দিলেন। ওদের মোল্লাজিকে আড়ালে নিয়ে আলাপ করে খবর পেলেন আমাদের পাশের গায়ে বরপক্ষের পাল্টাঘর আছে ও তাদের একটি মেয়েকে এই বরের সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্য একটা ইশারাও দিয়েছিল। চাচা বরের বাপ-চাচার সঙ্গে কথা বলে আমাদের মোড়লকে তাঁর নিজের ঘোড়া দিয়ে বলে দিলেন সে যেন আমার চাচার হয়ে বিয়ের প্রস্তাবটা পাড়ে। চাচা নামকরা জমিদার আর এরা সাধারণ রায়ৎ- এ যে কত বড় সম্মান আর ইজ্জতের কথা–।
আমি বললুম, খুব বুঝতে পেরেছি। আমার আব্বাকে বিয়েশাদির দোয়া-দরুদ পড়তে আমার জীবনে মাত্র একবার আমি দেখেছি। আমাদের বাড়ির দাসীর যখন বিয়ে হল আমাদের এক কুটুম-বাড়ির চাকরের সঙ্গে, পরের দিন বরের দেমাকটা যদি দেখতেন! তার পর কী হল বলুন।
তার পর আর বিশেষ কিছু বলার নেই। সেই রাত্রেই বরপক্ষ পাশের গায়ে গিয়ে বিয়েশাদি সাঙ্গ করে কনে নিয়ে মান-ইজ্জতের সঙ্গে বাড়ি ফিরল। তবে শুনেছি, আমাদের গাঁ থেকে বেরুবার সময় তারা নাকি ভিতরে ভিতরে শাসিয়ে গিয়েছিল যে এ তল্লাটের মাথা, আমার চাচা, তাদের হাত বন্ধ করে দিলেন কিন্তু সামনের হাটবারের দিন আমাদের গায়ের লোক যেন হুশিয়ার হয়ে হাট করতে যায়।
আর কনেটা?
সে কি আর বেশিক্ষণ চাপা থাকে, কার সঙ্গে সে মজেছে? ছোঁড়াটা অবশ্যি তুলকালাম দেখে গা-ঢাকা দিয়েছিল। তালাশ করে ধরে নিয়ে এসে বর সাজানো হল।
তা মেয়েটা ওরকম শেষ মুহূর্তে এরকম নাটুকে কাণ্ড করল কেন?
ওর নাকি কোনও দোষ নেই। সে বেচারী তার মাকে অনেকবার তার অমত বেশ জোর গলায়ই জানিয়েছিল, কিন্তু মা পাঠানকে বার বার বিরক্ত করতে সাহস পায়নি। আশা করেছিল, শেষ পর্যন্ত সবকিছু দুরস্ত হয়ে যাবে।
আমাদের খাওয়া অনেকক্ষণ সাঙ্গ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু উঠি-উঠি করে উঠিনি। আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলুম, শহর-ইয়ার অন্য কিছু-একটা ভাবছে এবং সেইটে চাপা দেবার জন্য ঘটনাটি বলে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললে, চলুন।
বসার ঘরে এসে বললে, কিন্তু খানের মেয়ের বিয়ে বাবদে আসল কথাটি আপনাকে এখনও বলা হয়নি। মেয়েটির বিয়ে চুকে-বুকে যাওয়ার মাসখানেক পরে খান একদিন তার বউকে বললে যে, সে বড় খুশ যে তার মেয়ের গায়ে পাঠান রক্ত আছে। ওই রকম ঘটনা পাঠান মুল্লুকে নিত্যি নিত্যি না ঘটলেও ব্যাপারটা একেবারে অজানা নয়।
আমি বললুম, তবেই দেখুন, ইসলাম যেসব অধিকার আমাদের দিয়েছে আমরা সেগুলো ব্যবহার করিনে। শুনেছি, আরবভূমিতে এখনও নাকি মেয়েরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মাঝে মাঝে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়।
শহর-ইয়ার একটু হেসে বললে, ঠিক ওই জিনিসই এখন বাঙলা দেশে অল্প অল্প আরম্ভ হয়েছে। যেসব মুসলমান মেয়েরা এখন ছেলেদের সঙ্গে কিছুটা অবাধে মেলামেশা করে তারা নিশ্চয়ই কিছুটা হিট দেওয়ার পর ছেলেরা বিয়ের প্রস্তাব পাড়ে।
আমি বললুম, ইংরেজিতেও বলে Courtship is the process a woman allowing herself to be chased by a man till she catches him.
শহর-ইয়ারের পছন্দ হল প্রবাদটি। তার পর বললে, তবেই দেখুন, যে অধিকার মুসলমান মেয়ের ছিল ইসলামের গোড়াপত্তনের সময় থেকে, সেইটেই সে ব্যবহার করল ইংরেজি সভ্যতার সংস্পর্শে এসে, অন্দরমহল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর। পাঠান মেয়েরা কিন্তু চিরকাল ধরে এ হক্কটা দরকার হলেই কাজে লাগিয়েছে। শুনেছি, তারা নাকি অনেক ক্ষেত্রেই বাপ-মার তোয়াক্কা না রেখে আপন পছন্দের ছেলেকে ভালোবাসতে জানে। আপনি তো আপনার লেখা নিয়ে কোনও আলোচনা করতে আমাকে দেন না, কিন্তু কাবুলে ওই যে একটি পাঠান মেয়ে আপনাকে ভালোবেসেছিল–
আমি বাধা দিয়ে বললুম, আপনি নির্ভয়ে, প্রাণভরে মণিকে নিয়ে যত খুশি আলোচনা করতে পারেন। এ কাহিনীতে আমি এমনই না-পাস ফেল মেরেছি যে ওটার কথা স্মরণে এলে মণির কাছে মনে মনে বার বার লজ্জা পাই আর মাফ চাই– এত বৎসর পরেও।
সে কী? আমি বুঝতে পারলুম না।
আমি গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বললুম, মণির কাহিনী গল্প নয়, হাজার পার্সেন্ট সত্য। আমি তার সিকির সিকিও ফুটিয়ে তুলতে পারিনি। আমি আমার জীবনে মাত্র একটি বার– ওই নিষ্পাপ কিশোরী মণির কাছ থেকে অকুণ্ঠ, সর্বত্যাগী, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য প্রণয় পেয়েছি। ও ছিল সত্যই কাবুল পাহাড়ের চুড়োর উপরকার ভার্জিন স্নো– এটা আমার ভাষা নয়, এটা বলেছিলেন মণির মুনিব বল, জাতভাই বল–জানো তো পাঠানরা সাম্যবাদে কীরকম মারাত্মক বিশ্বাসী– সেই রসকষহীন স্টোন-হার্ড-বয়েল ডিপ্লোমেট শেখ মহবুর আলি খান। তিনি আমাকে একাধিকবার বলেছিলেন যে, পেশাওয়ারে তাঁদের পরিবারে পরে এখানে ব্রিটিশ লিগেশনে পাঠান চিফ একাউন্টেন্ট থেকে আরম্ভ করে পাঠান অরডারলি পর্যন্ত- আবার সেই প্রাণঘাতী ডিমোক্রেসি মণির কৃপাদৃষ্টি লাভ করতে চেয়েছিল, কেউ কেউ বিশুদ্ধ পাঠান-রীতিতে মহবুর আলির কাছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে মহবুর আলির শেষ কথাগুলো, ওমেদারদের দৃঢ়তম প্রচেষ্টাও যেন মণির মনে কোনও ক্ষণেকের তরে ছায়াটুকু পর্যন্ত ফেলতে পারেনি। যেন ওসবের কোনও অর্থই হয় না, যেন তার বয়েস ষোল নয়– চার। তাই বলছিলুম, ভার্জিন স্নো, যার উপর রত্তিভর ধুলোবালি পড়েনি। তার পর সে আপনাকে দেখল–একবার দরজা খুলে দেবার সময়, আরেকবার যখন আপনার জন্য নাশতা নিয়ে এল। সেদিন আপনি এখানে ছিলেন আধ ঘণ্টাটাক। পরদিন আমার স্ত্রী বললেন, মণি যেন জীবনে এই প্রথম জেগে উঠল। নরনারীর একে অন্যের প্রতি বাছাই-অবাছাই-না-করা আকর্ষণ, বিবাহ, মাতৃত্ব সব যেন ওইদিন এক লহমায় সে বুঝে গেল। এ সমস্ত কবি একজন ধুরন্ধর ডিপ্লোমেটের মুখ থেকে হৃদয়ের সূক্ষ্মানুভূতি, স্পর্শকাতরতা যার কাছে আকাশকুসুম, সোনার পাথরবাটি।