পক্ষান্তরে ধর্ম যাই বলুক, আইন-কানুন যে আদেশই দিক, একই দেশে যুগ যুগ ধরে থাকার ফলে সামাজিক প্যাটার্ন ভিন্ন ভিন্ন ধর্মে খুব বেশি ভিন্ন হয় না। এর সর্বোকৃষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায় প্যালেস্টাইনে। ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান এই তিন সম্প্রদায়ের ভিতর তিন ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের আদেশ অনুযায়ী স্ত্রী-পুরুষে তিন ভিন্নপ্রকারের অধিকারভেদ- অথচ কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় সামাজিক প্যাটার্ন তিন সমাজেরই মোটামুটি এক। একটি ছোট উদাহরণ মনে পড়ল : হিটলারের ভয়ে যখন ইহুদি নরনারীরা জৰ্মনি ত্যাগ করে জেরুজালেমে এল তখন বার্লিনের কোনও কোনও অত্যাধুনিক যুবতী সুদ্ধমাত্র শর্ট শার্ট পরে রাস্তায় বেরুতে আরম্ভ করল। এই বে-আব্রু বেহায়া বেশ দেখে জেরুজালেমের আদিম ইহুদিরা লজ্জায় ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিত, এবং নিজেদের সবচেয়ে বেশি কুণ্ঠিত বিড়ম্বিত বোধ করত প্রতিবেশী খ্রিস্টান ও মুসলমানের সম্মুখে। কারণ তিন সম্প্রদায়েরই একই মান, একই স্ট্যান্ডার্ড আ, ইজ্জৎ, হায় সম্বন্ধে।
মনে মনে ভাবলুম, শহর-ইয়ার যা-ই বলুক, বাঙলা দেশেও কি তাই নয়? এমনকি আমাদের ইলিয়ট রোডের এংলো-ইন্ডিয়ানদের আচরণ লন্ডনের খ্রিস্টানদের সঙ্গে যত না মেলে তার চেয়ে বেশি সাদৃশ্য ধরে প্রতিবেশী হিন্দু-মুসলমানের সঙ্গে।
তার পর দুপুরে শহর-ইয়ারের সঙ্গে দেখা।
খানার টেবিলে বাবুর্চি একটা মাংসের কালিয়া দেখিয়ে বললে, এটা বেগম সায়েবা বেঁধেছেন। খেয়ে দেখি, আশ্চর্য, এক্কেবারে হুবহু কাবুলি রীতিতে তৈরি। কিন্তু রাধল কখন?
শহর-ইয়ার বোধ হয় একটুখানি মৌজে ছিলেন। বললেন, আমার মা এক কাবুলির কাছ থেকে এটা শেখেন। তার পর আরম্ভ করল সেই কাবুলির ইতিহাস। কেন জানিনে সেই খান সায়েবের এ দেশটা ভারি পছন্দ হয়ে যায়। আব্বা তাকে একটু জমি দিলেন। সে মামুলি ধরনের ঘরবাড়ি বেঁধে বিয়ে করল আমাদেরই এক রায়তের মেয়েকে। তার পর ডালভাত খেয়ে খেয়ে সে তার পাঠানত্ব ভুলে গেল, গাঁয়ের লোকও সেটা গেল ভুলে।
বিয়ের পরের বছর খানের একটি মেয়ে হয়েছিল। তার পনেরো বছর পর খান মেয়ের জন্য একটি বর বাছাই করে তার বিবিকে সুখবরটা দিল। কিন্তু পরের দিন সকালে বিবি খানকে জানালেন, মেয়ে তাকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে এ বর তার পছন্দ হয়নি।
তাজ্জবকি বাৎ! বাঙলা দেশের মুসলমান মেয়ে বিয়ের কথাটি মাত্র উঠলেই লজ্জায় ঘেমে-নেয়ে কাই হয়ে যায়। তার যে একটা মতামত থাকতে পারে সে নিয়ে তো কেউ কখনও মাথা ঘামায় না। এ আবার কী? খান বউকে অভয় জানিয়ে বলল যে আখেরে সব দুরস্ত হয়ে যাবে এবং বিয়ের ব্যবস্থা করে যেতে লাগল। হয়েও গেল সবকিছু ঠিকঠাক। বরপক্ষ এলেন ঢাকঢোল বাজিয়ে, আতশবাজি পোড়াতে পোড়াতে। তার পর যথারীতি এক উকিল আর দুই সাক্ষী বিয়ের মজলিস থেকে বরের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন অন্দরমহলে সেখানে কনেকে সাজিয়েগুজিয়ে, লম্বা ঘোমটা সহযোগে তাকে একটি আস্ত পুঁটুলি বানিয়ে চতুর্দিকে বসেছেন তার সখীরা। সখীদের কাজ হচ্ছে, উকিল বিয়ের প্রস্তাব করার পর কনে লজ্জায় হা বলতে দেরি করে বলে তারা তখন কনেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কবুল বলায়। উকিল প্রস্তাব পেশ করলেন। ভুল বললুম, প্রস্তাব ভালো করে শেষ করার পূর্বেই মেয়ে পরিস্কার গলায় বলে উঠল, না, কবুল নয়।
হঠাৎ কাহিনী থামিয়ে আমাকে বললে, কই, আপনার কাবুলি-কালিয়া খাচ্ছেন না যে বড়?
আমি বললুম, কী আশ্চর্য রসভঙ্গ করতে পারেন আপনি! বখতিয়ার খিলজির আমল থেকে অই সুবে বাংলার সুদীর্ঘ ইতিহাসে কোন মুসলমান বঙ্গনারী এরকম কবুল নয় বলেছে শুনি? তার পর কী হল বলুন।
আমি সেখানে ছিলুম না, তবু খানিকটে অনুমান করতে পারি। ওই কনের মজলিসে একশোটা বাজ একসঙ্গে পড়লেও বোধ হয় তার চেয়ে বেশি ধুন্দুমার লাগাতে পারত না। তারই ভিতর যাদের একটু মাথা ঠাণ্ডা ছিল তাঁরা কনেকে পাশের ঘরে তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিয়ে বোঝতে আরম্ভ করলেন, হাতে-পায়ে ধরলেন তাঁদের মাথায়, তাদের গোষ্ঠীর মাথায় যেন কেলেঙ্কারি না চাপায়। কনের মামারা তো পাগল হয়ে যাবার উপক্রম। আর বাপ, কাবুলি খান সাহেব- সে তার সর্ব পাঠানত্ব হারিয়ে ফেলা সত্ত্বেও একটা সামান্য জিনিসে তখনও তার কিছুটা আটকা পড়েছিল, সেটা তার প্রাচীন দিনের একখানা তলওয়ারে। কুড়ি বছর ধরে সে ওই তলওয়ারখানা সাফসুতরো রেখেছে। ওইটে নিয়ে করল ধাওয়া মেয়েকে খুন করবে বলে।
ওদিকে বাইরে বরপক্ষের কানে খবরটা পৌঁছে গিয়েছে। একসঙ্গে গর্জে উঠল সবাই, এ কী বেইজ্জতি? আমাদের গায়ের লোক দলে ভারী কিন্তু হলে কী হয়, ওদের সঙ্গে ছিল জনাতিনেক জাহবাজ লেঠেল– বরের মুরুব্বিদের ভিতর। আর জানেন তো, চাষাভূষোর বিয়েতে নানারকমের ঢং-তামাশার মেকি লড়াই হয়– ভাবটা যেন বরপক্ষ কনেকে ডাকাতি করে লুটে নিয়ে যাচ্ছে তাই সঙ্গে এনেছে যার যার লাঠি। ব্যস! লাগ লাগ লাগ। আমাদের গায়ের মোল্লাজি, মসজিদের ইমাম সাহেব, এমনকি বরপক্ষ যে তাদের মোল্লাজি সঙ্গে এনেছিল তিনি পর্যন্ত, সবাই মিলে আল্লা-রসুলের দোহাই দিয়ে ওদের ঠেকাবার জন্য প্রায় পায়ে ধরেন আর কি।
শেষটায় আমার চাচা খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে লড়াই ঠেকালেন। নিজের থেকেই বললেন, বিয়ের জন্য বরপক্ষের যা খরচা-পত্র হয়েছে তিনিই সেটা দিয়ে দেবেন।