ধীরে ধীরে উঠে সঙ্গীত-উৎসের সন্ধানে বেরুলুম। কোথা থেকে আসছে এ সঙ্গীত? বেহেশত থেকে না হলে খুঁজে পাওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব না-ও হতে পারে। মাটিতে পা ফেলতেই বুঝলুম এটা স্বপ্ন নয়। মোটামুটি অনুমান করলুম কোন জায়গায় এ গানের উৎস।
এ বাড়ির দেড়তলায় একটি ছোট্ট কুটুরি আছে। সেখানে দেখি শহর-ইয়ার নড়াচড়া করে কীসব সাজাচ্ছে। আমাকে দেখেই শুধাল, চা খেয়েছেন?
না।
বসুন এই মোড়াটায়, আমি বানিয়ে দিচ্ছি। কাটু স্টেশনে গেছে, ফেরার পথে হাট করে নিয়ে আসবে– আজকে হাটবার।
তখন ভালো করে তাকিয়ে দেখি শহর-ইয়ার কুটুরিটি চা বানাবার, এবং সেইখানেই আরামে বসে চা খাবার অতি চমৎকার ব্যবস্থা করেছে। বললে, এ ঘরের যা যা প্রয়োজন সেগুলো আমি বাক্সের ভিতর রেখে এসেছি স্টেশনে। কাটু আনতে গেছে। আপনি জানেন না, আমি বেলা-অবেলায় চা খাই। তাই এ ব্যবস্থা। রান্নাতে আমার কোনও শখ নেই। তবে মা ডাকসাইটে রান্নার আর্টিস্ট ছিলেন। হাঁসের বাচ্চা কি আর সাঁতার কাটতে পারে না তাই যদি নিতান্তই চান–।
একটু থেমে বললে, ভয় নেই, ভয় নেই। এ বাড়িটাকে আমরা উইক-এন্ড কটেজ রূপে দেখছিনে। এটা কী রকম জানেন? খুব বড়লোক যেরকম ব্যাঙ্কে টাকা রাখে। ওটা খরচ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, কারণ মাসের আমদানিটাই পুরো খরচ হয় না কোনও মাসেই।
আমি বললুম, আমার কী মনে হয় জানেন? আপনি যদি এখানে এসে আনন্দ পান তবে যত খুশি আসবেন। কিন্তু ভালো হয় ডাক্তারকে যদি সঙ্গে নিয়ে আসেন। বিশেষ করে এই কারণে বলছি, ভদ্রলোক যেরকম বেদম খাটছে সেটা তার পক্ষে ভালো নয়। এখানে এলে দেহমন দুই-ই তার জুড়োয়, আমার তো তাই মনে হয়। ওদিকে আপনারও কোনও অসুবিধা হবে না, কারণ আমি খুব ভালো করেই জানি আপনি এখানে আপন মনে ঘুরে বেড়ালে, আমার সঙ্গে বসে গল্প করলে উনি ভারি খুশি হন। নয় কি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ওঁকে ওঁর কাজ থেকে ছিনিয়ে এখানে আনা বা অন্য কোনখানে, সে আমার শক্তির বাইরে।
তার পর একটু চিন্তা করে নিয়ে বলল, হয়তো সবকিছুই আমার আদিখ্যেতা। আমার সমস্যা আর এমন কী নতুন? আমার শ্বশুরমশাইকে আমি দেখিনি কিন্তু শুনেছি সেই যে সকালবেলা বৈঠকখানায় গিয়ে বসতেন, তার পর ফের অন্দরমহলে ঢুকতেন রাতদুপুরে কিংবা তারও পরে– দু বেলার খাওয়া-দাওয়াই ওই বৈঠকখানায় ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে। সে হিসেবে তো আমি অনেক ভালো।
আমি জিগ্যেস করলুম, আর আপনার শাশুড়ি এ ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট ছিলেন?
কী জানি। তখনকার প্যাটার্নটাই ছিল আলাদা। আমার চোখের সামনে ছবিটা যেন পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে না। কারণ আমার বাপের বাড়িতে ছিল অন্য প্যাটার্ন। আম্মাকে আমি অল্প বয়সেই হারাই। আব্বা সমস্ত দিন কাটাতেন নামাজ পড়ে, তসবি, তিলাওত আর দীনিয়াতির কিতাব পড়ে। সংসারের সঙ্গে তাঁর মাত্র এইটুকু যোগ ছিল যে বেশ কড়া নজরে রাখতেন, আমার যত্ন-আত্তি ঠিকমতো হচ্ছে কি না। থাক, এসব কথা এক দিনে ফুরোতে নেই। মেয়েছেলের পুঁজিই-বা কতটুকু? ছেলেরা ঘোরাঘুরি করে, কত রকমের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাদের হয়। আপনিই কত না ভ্রমণ করেছেন, কত না অদ্ভুত অদ্ভুত
আমি বললুম, কিছু না, কিছু না। আমার বড় ভাইসাহেব তার জীবনে মাত্র একবার কলকাতা আসেন, সেখান থেকে আমাকে দেখবার জন্য এই বোলপুর ব্যস্! মেজদা বুঝি একবার আগ্রা গিয়ে সেখানে দুটিমাত্র দিন ছিল। দেশ-ভ্রমণের শখ তাঁদের মাইনাস নিল। অন্য লোকে আমার ভ্রমণ সম্বন্ধে যা খুশি রোমান্টিক ধারণা পোষণ করে করুক, কিন্তু আমি জানি, আমরা তিন ভাই যখন একসঙ্গে বসে আলাপচারী করি তখন কার দৌড় কতখানি। কিছু না, কিছু না–ওসবেতে কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না।
হুঁ, অনেক কিছু দেখেছেন বলে এসব কথা কইছেন। আচ্ছা, এবারে আমি নাইতে, সাজগোজ করতে চললুম।
***
সমস্ত দিন শহর-ইয়ার আপন কামরা থেকে বেরুল না। তবে কি সে নিজের সঙ্গে কোনওরকমের বোঝাঁপড়া করছে? তা হলে মাঝে মাঝে আবার গান গেয়ে উঠছে কেন? আল্লা জানে তার কিসের অভাব। একাধিকবার সে বলছে সে মুসলমান মেয়ে, বহু যুগ পরে এ যুগে এসে অন্দরমহল থেকে বেরিয়েছে; তাই তার সমস্যা এক নতুন প্যাটার্নের প্রথমাংশ- ক্রমে ক্রমে বহু মেয়ের চোখের জল আর ঠোঁটের হাসি দিয়ে প্যাটার্ন সম্পূর্ণ হবে। তার পর নব যুগান্তরের সমস্ত প্যাটার্নটা যাবে মুছে, ভাগ্যবিধাতা বসে যাবেন আবার নতুন আল্পনা আঁকতে।
কিন্তু আমার কাছে এটা কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছে না যে শহর-ইয়ার মুসলমান।
আইনের দিক দিয়ে দেখতে গেলে হিন্দু মেয়ে আর মুসলমান মেয়ের মধ্যে অধিকারে পার্থক্য আছে। এবং সে আইনের ভিত কুরান-হাদিসে। হিন্দুধর্মের ব্যবস্থা অন্যরকম– যেমন, হিন্দুসমাজে ব্রাহ্মণের হিন্দুর কোনও ধর্মানুষ্ঠান অবশ্যকর্তব্য নয়। মুসলমানকে দিনে পাঁচ ওৎ নামাজ পড়তে হয়, খ্রিস্টানকে রোববারে রোববারে গির্জেয় যেতে হয়, ইহুদিকে শনিবারে সিনাগগে, এবং খুদ হিন্দুধর্মে একমাত্র ব্রাহ্মণকে সন্ধ্যাহ্নিক করতে হয়। সেখানেও আবার স্ত্রী-পুরুষে কোনও পার্থক্য নেই : পুরুষকে যে রকম পাঁচ ওকৃৎ নামাজ পড়তে হয়, পুরো রোজার মাস উপোস করতে হয়, স্ত্রীলোককেও তাই। এবং তারই ফলে জানা-অজানাতে মুসলমান মেয়ে অনুভব করে যে স্বয়ং আল্লার সামনে যখন নামাজ-রোজার মারফতে পুরুষ-স্ত্রীলোককে একইভাবে দাঁড়াতে হয় তখন এই পৃথিবীতেই তার অধিকার কম হবে কেন? অবশ্য কর্মক্ষেত্রে অধিকারভেদ থাকার কথা, কিন্তু মূল নীতি তো অতিশয় অপরিবর্তনীয় সুদৃঢ়।