অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললে, একটি কেন, আপনি যত খুশি আমাকে প্রশ্ন জিগ্যেস করতে পারেন; আমি নিশ্চয়ই আমার সাধ্যমতো উত্তর দেব। কথা ছিল উনি লেবরেটরি থেকে সন্ধ্যা আটটায় ফিরে আসবেন। আমরা খেয়েদেয়ে সাড়ে নটার গাড়ি ধরে এখানে দেড়টায় পৌঁছব। তিনি নিশ্চয়ই কাজে ডুবে গিয়ে সব কথা ভুলে গেছেন, আর এরকম তো মাঝে মাঝে হয়ই। আমি আদপেই দোষ দিচ্ছিনে। যে যে-জিনিস ভালোবাসে তাতে মজে গিয়ে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে যাবে এ তো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আমি তার জন্য শেষ মুহূর্ত অপেক্ষা করে দুটি খেয়ে স্টেশনে এসে গাড়ি ধরলুম।
আমি তো কাল বিকেল পাঁচটার গাড়িতে কলকাতা আসতুমই।
একজেকটলি। যাতে সেটাতে কোনও নড়চড় না হয় তাই আসা।
এবারে পরিপূর্ণ বিশ্বাসে মনে মনে বললুম, বৃথা বাক্য।
বললুম, দুটি খেয়ে বেরিয়েছেন, এখন অল্প অল্প খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। সামান্য কিছু খাবেন?
আর কঘণ্টা বাকি? সকালবেলা চা খাব।
আমি একটু হেসে বললুম, কে বললে মুসলমান মেয়ে, বিশেষ করে আপনি, আপনাদের স্বাধীনতার ফল উপভোগ করতে পারছেন না? কটা হিন্দু মেয়েরই এ রকম সাহস আছে?
খুশি হয়ে বললে, এবং ঠিক সেই কারণেই এইখানে বসে আপনাকে বলেছিলুম, মুসলমান মেয়ে ডিফরেন্ট, কিন্তু কলকাতায় ফিরে গিয়ে যত চিন্তা করতে লাগলুম, ততই মনে হল এই যে আমি বার বার ডিফরেন্ট ডিফরেন্ট বলছি এটা আমারই কাছে খুব পরিষ্কার নয়, এবং যেটুকু পরিষ্কার সেটুকুও বুদ্ধি দিয়ে বুঝিনি, অনুভব করেছি হৃদয় দিয়ে। বুদ্ধির জিনিস বোঝানো তেমন কিছু কঠিন নয়, কিন্তু অনুভূতির জিনিস অন্যের ভিতর সঞ্চারিত করতে পারে শুধু আর্টিস্ট সে-ও বহু সাধনার পর। কিন্তু এ সব কথা পরে হবে। আপনি ঘুমুতে যাবেন না?
আর আপনি?
আমি একটা কাজ সঙ্গে নিয়ে এসেছি। তার কিছুটা এইখানে বসে করব। ওয়েস্ট জর্মনি থেকে একটা খবরের কাগজ এ দেশের নারীসমাজের অবস্থা জানতে চেয়েছে। কিন্তু বিপদ হল গিয়ে যে লেখাটেখার অভ্যাস একে তো আমার নেই, তার ওপর ইয়োরোপীয় কাগজের জন্য লেখা, ইয়োরোপ গিয়ে কন্টিনেন্টাল ডিগ্রি যোগাড় করা, আরও কত কী- এক কথায় ইয়োরোপ ইয়োরোপ সর্বক্ষণ ইয়োরোপ এই মনোবৃত্তিটাই আমাকে পীড়া দেয়। তাই লেখাটা তৈরি করবার জন্য কোনও উৎসাহ পাচ্ছিনে। কিন্তু আর না, আপনি দয়া করে শুতে যান।
নিশ্চয়ই যাব, যদি আপনিও কাজটা আজ রাতের মতো মুলতুবি রেখে ঘুমুতে যান।
আপনার কোনও আদেশ আমি কখনও অমান্য করেছি?
শুয়ে শুয়ে ভাবছিলুম, এ মেয়ে কী ধাতু দিয়ে তৈরি? এক দিক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, আমার পর্দানশিন মা-বোনের মতো শান্ত, নম্র, বিনয়ী। ট্রেনে একবার ওই যেটুকু যা হামলা করেছিল সেটা নিশ্চয়ই ব্যত্যয়। এটার মূলে আছে, আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা। মেয়েটির মন-হৃদয় যে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ সে-বিষয়ে আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই। এই আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তার সঙ্গে নিষ্পাপ চরিত্রের সম্মেলন এটা বিরল এবং এর সঙ্গে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্তি বা অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে আসা না-আসা অচ্ছেদ্য সম্পর্কে গ্রথিত নয়। সম্পূর্ণা অশিক্ষিতা কট্টর পর্দানশিন আমার সম্পর্কে এক ভাবী তাঁর স্বামীর নষ্টাচারে ক্রুদ্ধ হয়ে রাতদুপুরে থানা-ঘাটে হাঁকডাক ছেড়ে নৌকো যোগাড় করে চলে যান কয়েক মাইল দূরের গোসাঁইদের আখড়ায়। একে তো ছোট সেই শহরের সবাই সে কেলেঙ্কারির কথা জেনে যায়, তদুপরি ওই আখড়াটির মোহান্তের আবার খুব সুনাম ছিল না। শুধু তাই নয়, বউদিটি আখড়ায় দু দিন কাটানোর পর ফের সেই পাটনিকে ডেকে পাঠিয়ে ফিরে এলেন শহরে। দাসীকে দিয়ে জড়ো করালেন পাঁচজন মুরুব্বিকে। ওঁরা সবাই এসেছিলেন অত্যন্ত অনিচ্ছায়, কিন্তু জানতেন, না এলে আমার বউদিটি এঁদের প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে যা হুলস্থুল লাগাবে তার চেয়ে পঞ্চায়েতে যাওয়াই ভালো বউদির পয়েন্ট অতি পরিষ্কার আপনারা বিচার করে দিন, আমার তালাক পাওয়ার হক্ক আছে কি না। মুসলমান হিসেবে এস্থলে কেউ বউদির আচরণে কোনও খুঁত ধরতে পারে না। শেষটায় বউদি তালাক পেল, নির্মম কাবুলির মতো তার মহর, অর্থাৎ স্ত্রীধনের প্রত্যেক কড়ি আদায় করে মক্কা চলে গিয়ে সেখানে বাকি জীবন কাটাল। এর সব-কিছু সম্ভব হল কারণ আমাদের অঞ্চলের সবাই জানত, ওই বউদির মতো পুণ্যশীলা নারী আমাদের মধ্যে কমই আছেন। এবং তাঁর সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাস– আমি যা করছি ঠিকই করছি।
বউদির উদাহরণটি মনে এল বটে এবং শহর-ইয়ারের চরিত্রের সঙ্গে তাঁর চরিত্রের মিল আছে বটে, কিন্তু দু জনার বাতাবরণে আসমান-জমিন ফারাক। আমার সম্পর্কের দাদাটি ছিলেন মাইডিয়ার লোক, কিন্তু একেতে– অর্থাৎ একমাত্র ভাবীতে তাঁর জিনিয়াস সীমাবদ্ধ না রেখে ভূমাতে সুখের সন্ধান করতেন। ডাক্তার জুলফিকার তার ঠিক বিপরীত। অতিশয় একদারনিষ্ঠ এমনকি স্ত্রীর খামখেয়ালি পর্যন্ত হাসিমুখে মেনে নিয়ে তাঁকে সঙ্গ দেন। শহর-ইয়ারও তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসেন এবং ভক্তি করেন– সেটা এ যুগে কিছু কম কথা নয়।
তবে?
তার পর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।
স্বপ্নে শুনছিলুম কে যেন অতি মধুর কণ্ঠে গান গাইছে। প্রত্যেকটি স্বর, প্রত্যেকটি শব্দ যেন এক একটি নিটোল শিশিরবিন্দু। আর শিশিরবিন্দুরই মতো যেন আপনার থেকে জমে উঠছে; তার পিছনে কোনও সচেতন প্রচেষ্টা নেই। এরকম স্বতঃস্ফূর্ত মধুর ধ্বনি বছরের পর বছর আপ্রাণ রেওয়াজ করে হয় না এর সঙ্গে একমাত্র তুলনা করে শুধু বলা যায় এ যেন মাতৃস্তন্যে সহজ দুগ্ধসঞ্চার। সহজে বয় তার স্রোত। সহজে পান করে নবজাত শিশু। যে শুনবে সে-ই পান করবে এ সঙ্গীত শিশুরই মতো অপ্রচেষ্টায়।