তার পর এই শান্তির সুযোগ নিয়ে ইংরেজ এদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবসা চালিয়ে আমাদের শিল্প-বাণিজ্য পয়মাল করে দিল। প্রাচীনদের অনেকেই তখন বুঝতে পারলেন, স্বর্গরাজ্যে যাবার জন্য ইংরেজ এসব পরোপকার করেনি। স্পষ্ট দেখা গেল স্বর্গরাজ্যের গাইড-বুক মথিলিখিত সুসমাচার ইংরেজ অফিসার পড়ে না। পাদ্রিদের মারফতে বিলিয়ে দেয় এদেশের গায়ে গায়ে।
তাই যখন আরম্ভ হল অনটন, বস্ত্রাভাব, দুর্ভিক্ষ তখন দেশের লোক ইংরেজকে গালাগাল দিতে আরম্ভ করল। অসহিষ্ণুজন বোমা মারল, বিচক্ষণজন তার চেয়েও মারাত্মক বৈষ্ণবপ্রেমের হাতিয়ার আবিষ্কার করলেন।
কিন্তু ততমধ্যে আমাদের অভ্যাস খারাপ হয়ে গিয়েছে। সব জিনিসেই ইংরেজকে দোষ দিয়ে আমরা বিমলানন্দ উপভোগ করতে আরম্ভ করে দিয়েছি। তাজমহলে ফাটল দেখা দিলে ইংরেজের দোষ, বন্যা হলে ইংরেজের দোষ, বৃষ্টি না হলেও ইংরেজের দোষ, আর ভূমিকম্প হলে তো আলবৎ ইংরেজের দোষ, ওই যে ব্যাটাদের আলীপুরে খাসা যন্ত্রপাতি রয়েছে তাই দিয়ে ভূমিকম্পের দিনক্ষ্যাণ আগের থেকে বাৎলে দিল না কেন? ওদের কম্ম বুঝি আপন জাহাজের তদারকি করা আর ডানপিটেদের গৌরীশঙ্কর চড়ার সময় অষ্টপ্রহর বুলেটিন ঝাড়া!
এ বদ অভ্যাসটার জন্য অবশ্যি বেবাক দোষ দিশি লোকের ঘাড়ে চাপানো যায় না। ইংরেজের কুলগুরু গ্রিকরাই বলে গিয়েছেন, দাসের বিবেক থাকতে পাবে না, দাসের স্কন্ধে দায়িতুবোধ চাপানো যায় না–দাসের পাপ-পুণ্যের জন্য প্রভু দায়ী। তাই মহাপ্রভুর আপন কর্তব্য-নির্ধারণের সময় আমাদের মতামত কী তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। কোন্ রাস্তায় কটা ডাস্টবিন থাকবে তাই নিয়ে অবশ্যি মাঝে মাঝে সার্কুলার জারি করে আমাদের পরম আপ্যায়িত করেছেন এবং এই অভ্যাসের বশবর্তী হয়েই ক্রিস সায়েব লড়াইয়ের বাজারে স্বরাজ দেবার অর্থে বুঝেছিলেন আমাদের আপন লেটারহেড় ছাপাবার অধিকার হয়ে যাবে, কোন্ খ্যাংরায় কটা কাঠি থাকবে সে বিবেচনার হক্ক আমাদের ওপর বর্তাবে। আমাদের অনেকেই তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে বগল বাজিয়েছিলেন, পণ্ডিচেরি থেকে পর্যন্ত উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করবার ফরমান এসেছিল।
যাক এসব কথা– সেসব দিন গেছে।
ইতোমধ্যে স্বরাজটা ধপ করে চালকুমড়োর মতো উঠোনে পড়েছে আর তাই নিয়ে যে কামড়াকামড়ি লেগেছে– থাক, বাকিটা আর বলব না– এখন আর জেলে গিয়ে ভাঙাবার মতো কোনও ক্যাশ সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের বদ অভ্যাসটা গেল না, কিছু একটা বানচাল হলেই আমরা বলি কংগ্রেস দায়ী, ছেলেটা চাকরি না পেলে কংগ্রেসের দোষ, বউটা বাজা বেরোলে কংগ্রেসের নাক কাটো।
বেবাক ভুলে গিয়েছি যে আমরা স্বাধীন, এবং যেহেতু চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী রাজ-চক্রবর্তী নন তাই দেশের জনসাধারণ কংগ্রেসরাজের ভালো-মন্দ সবকিছুরই জন্য অংশত দায়ী।
তার অর্থ, জনগণের যেমন সর্ববিষয়ে দায়িত্ব আছে তেমনি কংগ্রেসকেও জনমত উপেক্ষা করে ফতোয়া জাহির হাতিয়ার বাহির করলে চলবে না। কংগ্রেস হয়তো উত্তরে বলবেন, জনমত না কচু! যে-দেশের দু আনা লোক ভালো করে খবরের কাগজ পড়তে পারে না, সে দেশে আবার জনমত! ইংরেজকে তাড়াবার জন্য আজেবাজে সক্কলেরই প্রয়োজন হয়েছিল বলে তারাই সব এখন রাজত্বের কর্ণধার হয়ে যাবে নাকি? বুনো শুয়ার খেদাবার জন্য যে মাচান তৈরি করা হয়েছিল সেইটে এখন রাজসিংহাসন হয়ে যাবে নাকি?
প্রশ্নটা একেবারে ন-সিকে ভুয়ো নয়, কারণ আমাদের জনগণের কার্যকলাপ সেদিন শেয়ালদায় দেখা গেল, নিত্যি নিত্যি শোফার ঠ্যাঙানোতে, খেলার মাঠের দাবড়ানোতে দেখতে পাই। জনমত যদি জনকর্মের মতোই হয় তবে তাকেই-বা কুইট ইন্ডিয়ার বখরাদার করা হবে না কেন?
কবুল। কিন্তু প্রশ্ন এবং এই আমার শেষ প্রশ্ন– কংগ্রেস যখন গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। তখন সুস্থ জনমত গঠন করার দায়িত্ব কি কংগ্রেসেরই নয়?
ইংরেজ জনমত গঠন করতে চায়নি বিদেশি রাজা কস্মিনকালেও জনমত গঠন করে না। কাজেই ইংরেজের কথা বাদ দিন।
হিটলারও তো জনমত গঠন করেননি। তবুও তো তিনি জার্মানিকে শক্তিশালী রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
খাঁটি কথা। হিটলারের পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী ফ্রনিঙের আমলে জার্মান রাষ্ট্রে জনমত ছিল প্রচুর এবং রাষ্ট্র ছিল কম-জোর। এবং পার্টির প্রাচুর্য থেকে যদি জনমতের প্রসার স্বীকার করতে হয় তবে ব্রুনিঙের জার্মানির সামনে দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম করতে হয়। ১৯৩২ সালে জার্মানিতে সবসুদ্ধ সাতাশখানা পার্টি প্রতি গণনির্বাচনে ঝামেলা লাগাত।
হিটলার যে জনমত গড়েননি তার জন্য তাঁকে খেসারতিও দিতে হয়েছিল। সেই খেসারতির ধাক্কা সামলাবার ভার পড়েছিল গ্যোবেলসের ওপর। জার্মানির নিষ্পেষিত জনমত ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে। গ্যোবেলস সায়েবের প্রপাগান্ডার চাবুক মরা-ঘোড়াকে খাড়া করেও খাড়া করতে পারল না। অর্থাৎ অস্ত্রবলে, ব্লিৎসক্ৰিগের ফলে জার্মানি লড়াই জিতেও শেষ পর্যন্ত হার মানলো।
স্ট্যালিনও জনমত চাননি কিন্তু তিনি হিটলারের চেয়ে বহুৎ বেশি হুঁশিয়ার। আর হাজার হোক রুশিয়ার ধনবন্টন পদ্ধতি জার্মানির চেয়ে অনেক বেশি সাম্যবাদী এবং গণতান্ত্রিক যদিও জার্মান মজুরের বিত্তসম্বল রুশ মজুরের চেয়ে অনেক বেশি। তা সে যা-ই হোক, লড়াই লেগে যাওয়ার পর স্ট্যালিনকেও রুশ জনমতের দর্গায় গোটাকয়েক মুরগি জবাই করে পীরকে জাগ্রত করতে হয়েছিল। কথাটা নিছক তুলনা নয়, কারণ সবাই জানেন, স্ট্যালিন বহু গির্জার দরজা খুলে দিলেন, হোলি রাশিয়ার নাম নিয়ে বিস্তর দোহাই-কিরা কাটলেন, জাপান হেরে যাওয়ার পর বললেন, এতদিন বাদে আমরা পোর্ট আর্থারের প্রতিশোধ নিতে পারলুম। আমরা কারা? জারিস্ট রাশিয়া? স্ট্যালিনিস্ট রাশিয়া? একই কথা!