এই ফরাসিকে না খেদানো পর্যন্ত জর্মন ও রুশ সাহিত্য কোনও প্রকারের উন্নতি করতে পারেনি।
এইবার গোড়ার কথায় ফিরে যাই। ইংরেজের মতো ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এমন কোনও কু-মতলব নেই যে কেন্দ্র তাবত ভারত শোষণ করে খাবেন। যুক্তপ্রদেশের দোবেজি পড়েজি হিন্দি ভাষার জোরে ভারতময় দাবড়ে বেড়াবেন ও মতলব নিয়ে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করা হচ্ছে না। পণ্ডিতজি ভালো হিন্দি জানেন না, তিনি জানেন অতি উত্তম উর্দু, এবং সর্দারজির হিন্দি শুনেও কোনও দোবেজি পড়েজি ঈর্ষাতুর হবেন না। তাই হিন্দি দিয়ে যদি ভারতবর্ষ শোষণ করতে হয় তবে এদের বেতন দিয়ে বাড়ি পাঠাতে হবে।
আমাদের আদর্শ হচ্ছে ভারতবর্ষকে শক্তিশালী রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার। তার জন্য প্রত্যেক প্রাদেশিক ভাষাকে বলশালী হতে হবে। বলশালী হতে হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা প্রত্যেক প্রদেশকে আপন ভাষায় করতে হবে। ইংরেজি সে পথে অন্তরায় হয়ে আসর জমিয়ে বসেছিল, আজ যদি ইংরেজির শূন্য আসনটি হিন্দি দখল করে বসে তবে আমরা যে আবছায়ায় ছিলুম সেই আবছায়ায়ই থাকব।
এই জিনিসটিই আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে।
ইংরেজ প্রত্যেক প্রদেশেই কয়েক হাজার বা কয়েক লক্ষ লোককে ইংরেজি শিখিয়ে আপন রাজত্ব চালিয়ে নিত। ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের এই কয়েক লক্ষ লোকের কয়েকজন ইংরেজির মাধ্যমে একজোট হয়ে কিছুকাল পরে কংগ্রেস তৈরি করে স্বাধীনতার জন্য ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। ইংরেজ তাতে কিছুমাত্র বিচলিত হল না, কারণ সে বিলক্ষণ জানত এসব লেকচার দেশের জনসাধারণ কিছুই বুঝতে পারে না বলে পোলিটিশিয়ানরা ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরামের মতো শুধুই তড়পাচ্ছেন। যখনই দরকার হবে এঁদের ওপর চোটপাট করে এঁদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু যখন সর্দারজি গুজরাতি ভাষায় বরদলৈএতে আগুন ছড়াতে আরম্ভ করলেন তখন ইংরেজ প্রমাদ গুনল। যে গণ-আন্দোলনের ফলে ভারতবর্ষ শেষটায় স্বরাজ পেল তার অধিকাংশ বক্তাই আপন। মাতৃভাষার মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
স্বাধীনতালাভ কর্ম সমাধান হয়েছে। সেটা অপেক্ষাকৃত সরল কর্ম। কঠিনতর কর্ম হচ্ছে। দেশ থেকে দুঃখ-দারিদ্র্য দূর করে শিক্ষাবিস্তার করা, স্বাস্থ্যের উন্নতি করা। এইখানে এসে রাষ্ট্রভাষামত্ত স্বৈরতন্ত্রীরা করেন প্রথম ভুল। তারা ভাবেন রাষ্ট্র নির্মাণে জনসাধারণের আর কোনও সহযোগিতার প্রয়োজন নেই। কাজেই ইংরেজির শূন্য আসনে যদি হিন্দি এসে গেঁট হয়ে চেপে বসে তা হলে কোনও ক্ষতি তো হবেই না, বরং ইংরেজেরই মতো তাঁরা বেধড়ক রাজত্ব চালাতে পারবেন।
অর্থাৎ ইংরেজের আমলে যা হয়েছিল তারই পুনরাবৃত্তি হবে। একদল লোক হিন্দি শিখবেন, বড় বড় নোকরি করবেন, বহিরাগত হিন্দিভাষিদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে এক নতুন অভিজাত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করবেন, আর বাদবাকি চাষাভূষো আমরা পাঁচজন আবছায়া থেকে তিমিরে নিমজ্জিত হব।
তাই দেখতে হবে রাষ্ট্র গঠনের সর্বপ্রচেষ্টার সঙ্গে যেন আপামর জনসাধারণ সংযুক্ত থাকে। এবং সে জিনিস মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনও মাধ্যমের দ্বারা সফল করা সম্ভবপর হয় না। রাষ্ট্রভাষার উৎকট সমর্থনকারীরা বলবেন, মাতৃভাষায় লেখা হলেই কি সব মানুষ এইসব রাষ্ট্র নির্মাণের কুটিলতম প্রচেষ্টার কথা বুঝতে পারবে?
উত্তরে বলি, সকলে পারবে না, কিন্তু অসংখ্য লোক পারবে।
আমরা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রে শিক্ষাব্যবস্থার যে স্বপ্ন দেখছি তাতে দেশের শতকরা নব্বই জন মাইনর, মেট্রিক পর্যন্ত পড়বে। এবং সে মাইনর মেট্রিকের শিক্ষাদান অনেক বেশি উন্নত পর্যায়ের হবে। ইংরেজি বা হিন্দির জন্য তারা প্রাণপাত করবে না বলে (অবশ্য স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রভাষা হিন্দি অপশনাল হিসেবে পড়বার ব্যবস্থা সবসময়ই রাখতে হবে আজ যেমন কেউ শেখে সংস্কৃত, কেউ শেখে ফার্সি) তারা অতি উত্তম বাংলা শিখবে এবং ইংলন্ড, ফ্রান্স, চীন, ইরানে যেরকম সাধারণ লোক মাতৃভাষায় লেখা দেশের শ্রেষ্ঠ পুস্তক পড়তে পারে, এরাও ঠিক তেমনি দেশের উন্নততম জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। দেশের তাবত লোকেই যে উত্তম উত্তম পুস্তক পড়বে সে কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয় কারণ সকলেই জানেন জ্ঞানতৃষ্ণা কোনও বিশেষ শ্রেণি বা সমাজের মধ্যে নিবদ্ধ নয়, এমনকি উচ্চশিক্ষা পাওয়া না পাওয়ার ওপরও সে জিনিস সম্পূর্ণ নির্ভর করে না। কত বি.এ. এম.এ. পরীক্ষা পাসের পর চেক্ বই ছাড়া অন্য কোনও বইয়ের সন্ধানে সময় নষ্ট করে না, আর কত মাইনরের ছেলে গোগ্রাসে যা পায় তাই গেলে– তাই মাতৃভাষা দেশের সংগঠন কর্মের মাধ্যমে হলে যে কোনও তত্ত্বানুসন্ধিৎসু অল্প চেষ্টাতেই দেশের সর্বোত্তম প্রচেষ্টার সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। এর সত্যতা সপ্রমাণ হয় আরেকটি তথ্য থেকে ইউরোপের বহু সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, আবিষ্কর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন না করেও যশস্বী সৃষ্টিকার হতে সমর্থ হয়েছেন।
জিনিসটা এতই সরল যে প্রবাদরূপে বলা যেতে পারে,–
গণভাষার সাহায্য ভিন্ন গণরাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না।
জয় হিন্দি, কিন্তু রাষ্ট্রভাষা হিন্দি যেন সে পথে অন্তরায় না হয়। — ওমর খৈয়াম
.
জনমত
ইংরেজ এ-দেশ দখল করে শান্তি এনেছিল বলে প্রাচীনদের অনেকেই ইংরেজের প্রশংসা করতেন। খুনখারাবির সময় আর্তৰ্জন প্রথম কোম্পানির দোহাই দিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করত আর ছোরা তবুও এগিয়ে এলে মহারানীর দোহাই কাড়ত। সাক্ষ্য দেবার সময় আর পাঁচজন বলত লোকটা এমনি পাষণ্ড, ধর্মাবতার, যে সে মহারানীর দোহাই পর্যন্ত অমান্যি করে গেল।