উত্তম প্রস্তাব, এ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই। বরঞ্চ আমরা কিঞ্চিৎ আরবি জানি বলে মিশর সম্বন্ধে আপন মুখে ঝাল খেতে পারি, কিন্তু মিশরের লোক না জানে ইংরেজি, না জানে ভারতীয় কোনও ভাষা। তাই ভারত সম্বন্ধে মিশরের জ্ঞান এতদিন পর্যন্ত ইংরেজের কুৎসা নিন্দার ওপর নির্ভর করেছে। আজ যদি সিদনা শেখের প্রস্তাব হাড়-মাংস নিয়ে শরীর ধারণ করে তবে আমি উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করব।
কিন্তু প্রশ্ন, যেসব ছাত্র-শিক্ষক এদেশে আসবেন তারা অধ্যয়ন করবেন কোথায়?
কলকাতা, বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে? কাশী, ভট্টপল্লির চতুষ্পঠীতে? দেওবন্দ, রামপুরের মাদ্রাসায়? এঁরাই তো আমাদের ত্রিশরণ।
দেওবন্দ, রামপুর গিয়ে যে এদের মোক্ষলাভ হবে না সে-কথা বিনাবাক্য ব্যয়েই স্বীকার করে নিতে পারি। তার কারণ দেওবন্দ রামপুর পড়ায় অজহরেরই নিসাব বা পঠনবস্তু বেশ কিছুটা জল ঢেলে, মিশ্রির শরবৎ বানিয়ে। তাতে যে ভেজাল নেই সে কথাও হলপ করে বলা যায় না। তুলনা দিয়ে কথাটা বললে আমার বক্তব্য ঈষৎ খোলসা হবে। আজ যদি অক্সফোর্ডের ইংরেজ ছেলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য, ইংলন্ডের ইতিহাস পড়তে আসে তবে যে পরিস্থিতিটা হবে তার সঙ্গেই মিশরের বিদ্যার্থীর দেওবন্দ গমনের তুলনা হতে পারে।
তবে কি তারা ভট্টপল্লিতে যাবেন?
মুশকিল! ভট্টপল্লির জীবন ও মিশরীয় মুসলমানের চলা-বসাতেই এত পার্থক্য রয়েছে যে একে অন্যকে বরদাস্ত করতে করতেই তাদের উভয়পক্ষের বেশ কয়েক বছর কেটে যাবে বহিরাগতের শাস্ত্রাধিকার আছে কি নেই, সে প্রশ্ন না-ই বা তুললুম।
অথচ ভট্টপল্লি-দেওবন্দই তো ভারতীয় ঐতিহ্যের সন্তান। তা তারা আজ যত নির্জীবই হোন না কেন, যত অনাদৃত অবহেলিতই হোন না কেন।
তবে কি তারা কলকাতা, বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে দাখিল হবেন। ত্রাহি মধুসূদন, তওবা, তওবা। ভারতীয় ঐতিহ্যের কোন মণি-মাণিক্য সঞ্চিত আছেন এইসব দো-আঁসলা, অকালপকু, কেরানি-প্রসবিনী বিদ্যায়তনের শ্বেত-সমাধির মাঝখানে? ভারতীয় সাহিত্য এখানে সপত্নী-পুত্রের সম্মান পায়, ভারতীয় সঙ্গীত, স্থাপত্য, চিত্র, নাট্য এখানে বন্ধ্যা পাণ্ডিত্যের কচকচানির বিষয়বস্তু, শেক্সপিয়ার-মিল্টনের ভূত এ গোরে প্রেতের মতন নাকিসুরে কথা কয়, অর্থশাস্ত্রের মিসিং লিঙ্ক মার্শাল টাউসিগ এখানকার শাখা-প্রশাখার শাখা-মৃগ, এখানকার ইতিহাসদেবী স্মিথের, অতিবৃদ্ধা, লোলচৰ্মা রক্ষিতা এবং এখানকার দর্শন অধ্যয়ন সত্যই অমাযামিনীর অন্ধকার গৃহে অন্ধ কর্তৃক অনুপস্থিত অসিত মার্জারের অনুসন্ধান এবং মার্জারটি সে-গৃহে কস্মিনকালে প্রবেশও করেনি।
তবে কি অতিথিকে চাল-চিনি বাড়ন্ত বলে ফিরতি নৌকার সন্ধান করতে বলব? তা-ও তো পারিনে।
তাই বলি স্বাগতম, স্বাগতম–যে সামান্য আরবি জানি তাই দিয়ে বলি অহলান ওয়া সহলান। –ওমর খৈয়াম
.
গণভাষা
রাষ্ট্রভাষার স্বরূপ কী হবে এবং তার সম্প্রসারণ কতদূর, সে-কথা আলোচনা করার পূর্বে স্বাধীনতা লাভের ফলে ভারতবর্ষে যে নতুন বাতাবরণের সৃষ্টি হয়েছে সেটা ভালো করে বুঝতে হবে।
ইংরেজ জাতি পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে কিন্তু তার কেন্দ্র ইংলন্ডে। ইংরেজের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য, বৈদগ্ধ্যের উন্নতি অনেকখানি নির্ভর করে জগৎ-জোড়া ইংরেজের ওপর; তাই ইংরেজের প্রয়োজন তার রাজত্বের সর্বদূর ভূখণ্ড এবং তার শাসকের সঙ্গে যেন ইংলন্ডের যোগসূত্র অবিচ্ছিন্ন থাকে। এই যোগসূত্রের নাম ইংরেজি ভাষা এবং এটাকে ইংরেজ কিছুতেই ছিঁড়তে দেয় না। তাতে করে যে ভূখণ্ডে সে রাজত্ব করছে তার আপন ভাষার সর্বনাশ হোক, সে দেশের বৈদগ্ধ্য উচ্ছন্নে যাক ইংরেজের কোনও আপত্তি নেই।
এ তত্ত্বটা আমরা ঠিক ঠিক বুঝতে পারিনি, কারণ, ইংরেজ যখন এদেশে আসে তখন ভারতবর্ষের রাষ্ট্রভাষা ছিল ফার্সি। সে ভাষা সমূলে উৎপাটন করে ইংরেজ এদেশে ইংরেজি চালায়। কিন্তু তাতে আমাদের কিছুমাত্র ক্ষতি হয়নি, কারণ ফার্সি এদেশের আপন ভাষা নয়, ইংরেজির মতো সে-ও বিদেশি। এমনকি আর কিছুদিন গেলে ফার্সি হয়তো নিজের থেকেই হিন্দুস্তানির জন্য রাষ্ট্রভাষার আসন ছেড়ে দিত।
ইংরেজি ভাষার সাহায্য ছাড়া ইংরেজ এ দেশটাকে ব্যাপকভাবে শোষণ করতে পারবে না বলেই সে এদেশে ইংরেজি চালিয়েছিল এবং গোড়ার দিকে এদেশে প্রাদেশিক ভাষাগুলো ইংরেজি থেকে বিস্তর মাল-মশলা আহরণ করে সমৃদ্ধিশালী হয়েছিল সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই। তার পর একটা জায়গায় এসে সবকটা প্রাদেশিক ভাষা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। এই বাঙলা ভাষার কথাই ধরুন। আমরা এখনও নভেল, ছোটগল্প, আর দু চারখানা মামুলি প্রবন্ধ নিয়েই মাতামাতি করি। বিজ্ঞান, দর্শন, অলঙ্কার, অর্থশাস্ত্র, ফলিতবিজ্ঞান সম্বন্ধে কুচিৎ কখনও একখানা বই লেখা হয় এবং তার প্রথম সংস্করণ ফুরোতে দশ মাস লাগে, হয়তো-বা কখনও একদম ফুরোয়ই না।
তার কারণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হচ্ছে ইংরেজিতে এবং ইংরেজির ভূত ঘাড় থেকে না নামা পর্যন্ত রোগী আর কোনও ভাষায় কথা কইবে না।
তুলনা দিয়ে বক্তব্যটা আরও খোলসা করি। লাতিন ভাষা যতদিন ইউরোপীয় গুণীজ্ঞানীর বিদ্যা-চৰ্চার ভাষা ছিল, ততদিন ফরাসি-জর্মন কোনও ভাষাই ব্যাপকার্থে সমৃদ্ধিশালী হতে পারেনি। তার পর লুথারের প্রটেস্টান্ট সর্ষের ঠেলায় যখন লাতিন ভূত ইউরোপের ঘাড় থেকে নামল তখন ফরাসি এসে চাপল জর্মন এবং রুশের স্কন্ধে– স্বয়ং ফ্রেডরিক দি গ্রেট জর্মনে না লিখে কাব্য রচনা করেছিলেন ফরাসি ভাষায় (এবং সে কাব্য এমন ওঁচা যে বিখ্যাত জর্মন কবি হাইনরিশ হাইনে বলেছেন, জর্মন সাহিত্যে ফ্রেডরিকের সবচেয়ে বড় অবদান- তিনি জর্মন ভাষায় কিছু রচনা করেননি)।