***
এই সম্পর্কে আরেকটি কথা মনে পড়িল। প্রথম যৌবনে এক গুরুর কাছে শিক্ষালাভ করার চেষ্টা করি। সেই প্রাতঃস্মরণীয় গুরু অন্ততপক্ষে একশতটি ভাষা জানিতেন ও খুব সম্ভব একশত হইতে দুই শতের মধ্যেই ঠিক হিসাব পড়ে। এবং প্রত্যেকটি ভাষাই সাধারণ গ্র্যাজুয়েট যতটা সংস্কৃত বা ফারসি জানে তাহা অপেক্ষা বেশি জানিতেন। সাধারণ এ্যাডুয়েট আট বৎসর সংস্কৃত অধ্যয়ন করে। সেই হিসাবে গুরুর বয়স অন্ততপক্ষে ১৫০ x ৮ = ১২০০ বৎসর হওয়া উচিত ছিল; যদি তিন-তিনটি ভাষা একসঙ্গে শিখিয়া থাকেন, তবে তাঁহার বয়স ৪০০ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু গুরু বিরিঞ্চি বাবা নহেন ও ৬০ বৎসর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। এবং শেষের দশ বৎসর খুব সম্ভব কোনও নতুন ভাষা শিখেন নাই।
তবেই প্রশ্ন এই অলৌকিক কাণ্ড কী প্রকারে সম্ভবপর হইল?
স্বীকার করি শুরু ভাষার জহুরি ছিলেন ও ভাষা শিখিতে তাহার উৎসাহের অন্ত ছিল না। কিন্তু তবু আমার বিশ্বাস ভালো শুরু পাইলে, অর্থাৎ শিক্ষাপদ্ধতি উত্তম হইলে অল্পায়াসে এক ডজন ভাষা দশ বত্সরে শিখা যায়। শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে আরেকটি জিনিসের প্রয়োজন, তাহা নিষ্ঠা। এবং তৃতীয়ত কণ্ঠস্থ করা অপ্রয়োজনীয়– এই অদ্ভুত বিজাতীয় অনৈসর্গিক পাণ্ডববর্জিত ধারণা মস্তিষ্ক হইতে সম্পূর্ণরূপে নিষ্কাষণ করা।
***
আরেকটি প্রশ্ন। প্যারিস লিখিব, না পারি? ফরাসিস লিখিব, না ফরাসি, না ফ্রেঞ্চ; বেৰ্লিন না বার্লিন; এ্যাক্সেলা শাপেল না আখেন (প্রথমটি ফরাসি উচ্চারণ ও আন্তর্জাতিক ভাষায় ইহাই চলে, কিন্তু দ্বিতীয়টি জর্মন ও শহরটি জর্মনিতে অবস্থিত? মস্কভা, না মস্কৌ, না মস্কো; শ্যাম না সিরিয়া যিশু, না য়েশু, না জীসস? ১৮৭০-৮০ খ্রিস্টাব্দে এইসব সমস্যা সমাধান করিবার জন্য কলকাতায় একটি কমিটি নির্মিত হয়, তাহার রিপোর্ট এযাবৎ দেখি নাই। কোনও পাঠক দেখিয়াছেন কী?
.
০৬.
ভর্তৃহরি বলিয়াছেন, প্রিয়ভাষীজনকে ধনহীন মনে করা দুর্জনের লক্ষণ। কিন্তু প্রিয়ভাষণেরও তো একটি সীমা থাকার প্রয়োজন। আমরা স্থির করিয়াছি বিলাতি কমিশন না আসা পর্যন্ত টু শব্দটি পর্যন্ত করিয়া রাজনৈতিক আবহাওয়া অহেতুক উষ্ণ করিব না, বিলাতি কর্তাদের গরমে কষ্ট হইতে পারে। কিন্তু এই সুযোগে অ্যাটলি সাহেবের প্রিয়ভাষণ যে অলঙ্কারের উপর অলঙ্কার পরিধান করিতেছে, তাহাতে সন্দেহ হইতেছে– বধূটি খুব সম্ভব কুরূপা। তবু গুরুজনেরা বলিতেছেন, বিশ্বাসে কৃষ্ণ মিলয়। হইতে পারে; কিন্তু কন্যাকর্তাকে বিশ্বাস করিয়া সুরূপা বধূলাভের আশা নগণ্য বলিয়াই কনে দেখার প্রথা এদেশে প্রচলিত।
সে যাহাই হউক, সর্বশেষ উপমা শুনিলাম নিউইয়র্কের কোনও এক খবরের কাগজের লন্ডনস্থ সংবাদদাতার নিকট হইতে। তিনি মনে মনে এক নদীর ছবি আঁকিয়াছেন, তাহার একপারে অ্যাটলি সাহেব, হাতে নাকি বহুমূল্য স্বরাজ; অন্য পারে তাবৎ ভারতীয়। সংবাদদাতা বলিতেছেন, শুধু কংগ্রেস, শুধু লীগ, শুধু রাজসংঘ, শুধু হরিজন সন্তরণ করিয়া উত্তীর্ণ হইলেই হইবে না; সকলকে একযোগে একসঙ্গে সে বৈতরণী পার হইতে হইবে।
বাল্যবয়সে বিস্তর ভারতীয় বিস্তর নদী সাঁতরাইয়া পার হয়, এবারেও চেষ্টা করিবে; কিন্তু প্রশ্ন– কে কে জলে নামিবেন? কংগ্রেস তো নামিবেনই, সায়েবের হাতে যখন স্বরাজ রহিয়াছে, লীগ নামিবেন কি? কারণ সংবাদদাতা বলিয়াছেন, সায়েবের হাতে স্বরাজ, পাকিস্তান আছে কি না বলেন নাই। না হয় লীগও নামিলেন; কিন্তু রাজারা তো কখনও সাঁতার কাটেন না। প্রজাদের পৃষ্ঠে বসিয়া যে যাইবেন তাহারও কোনও উপায় নাই; কারণ প্রথমত প্রজাদের সে-সন্তরণে যোগ দিবার কোনও প্রস্তাবই হয় নাই, দ্বিতীয়ত তাহারা সরেজমিন উপস্থিত থাকিলে মণিটির হিস্যা পাইবার জন্য চেল্লাচেল্লি করিবে, হয়তো-বা সাকুল্য মণিলাভের তালে থাকিবে। কাজেই মনে হইতেছে রাজারা দুইশত বৎসরের প্রাচীন খানদানি বাতরোগের অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে কৃত সনাতন সন্ধিশর্তের দোহাই দিয়া পাড়ে দাঁড়াইয়া রহিবেন অথবা শূন্যে হাত-পা ছুড়িয়া সাঁতারের ভান করিবেন। হরিজন নামিতে পারেন, কারণ কূপ অপবিত্র হইতে পারে, মা-গঙ্গার সে ভয় নাই।
কিন্তু একযোগে সাঁতার কাটিতে হইবে। বয়নাক্কাটা বিবেচনা করুন। রুশ বাদ দিলে তামাম ইউরোপ ভারতের চেয়ে ক্ষুদ্র, তবু তথাকার কর্তারা সাঁতার কাটিবার সময় একে অন্যের গলা এমনি টিপিয়া ধরেন, যাহাকে বলে মহাযুদ্ধ। আর শুধু তাহাই নহে। পৃথিবীর আপামর জনসাধারণকে সেই নদীতে নামানো চাই, কি অস্ট্রেলিয়া, কি আমেরিকা, কি ভারত–কাহারও রেহাই নাই। এই এক জন্মেই দুইটি দক্ষযজ্ঞ দেখিলাম। তাহারই এক ছাগ-মুণ্ড তম্বি করিয়া বলিতেছেন, একযোগে সাঁতরাও।
না হয় সঁতরাইলাম, কিন্তু তথাপি প্রশ্ন ক্রিপস-নদীতে যে হাঙর-কুমির আমাদের পা কামড়াইয়া সবকিছু ভণ্ডুল করিয়া দিয়াছিলেন তাঁহারা ইতোমধ্যে বৈষ্ণব হইয়া গিয়াছেন কি?
সর্বশেষ প্রশ্ন, সায়েবের হস্ত মুষ্টিবদ্ধ। এ যেন ফোকা ধোকা খেলা। আমরা সকলে একযোগে হাঙ্গর-কুমির এড়াইয়া নদী পার হইয়া একবাক্যে চিৎকার করিয়া বলিব, আমরা ফোকা চাই অথবা ধোকা চাই, তখন সায়েব হস্তানন্মাচন করিবেন।