এইবারে নিবেদন, ইতিহাস আলোচনা করে দেখান তো, পৃথিবীর কোথায় কোন্ মহান এবং বিরাট আন্দোলন হয়েছে জনগণের কথা এবং বোধ্য ভাষা বর্জন করে?
এ তত্ত্ব এতই সরল যে, এটাকে প্রমাণ করা কঠিন। স্বতঃসিদ্ধ জিনিস প্রমাণ করতে গেলেই প্রাণ কণ্ঠাগত হন।
আটঘাট বেঁধে পূর্বেই প্রমাণ করেছি এসব আন্দোলন নিছক ধর্মান্দোলন (অর্থাৎ আত্মা-পরমাত্মাজনিত) নয়– এদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অংশ অনেক বেশি গুরুত্বব্যঞ্জক।
তাই ভারতবর্ষ এখন যে নবীন রাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা করছে, তার সঙ্গে এইসব আন্দোলনের পার্থক্য অতি সামান্য এবং তুচ্ছ। এই যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার সাফল্যের বৃহদংশ নির্ভর করবে জনগণের সহযোগিতার ওপর– এ কথা পরিকল্পনার কর্তাব্যক্তিরা বহুবার স্বীকার করেছেন এবং ক্রমেই বুঝতে পারছেন, উপর থেকে পরিকল্পনা চাপিয়ে কোনও দেশকে উন্নত করা যায় না যদি না নিচের থেকে, জনগণের হৃদয়মন থেকে সাড়া না আসে, সহযোগিতা জেগে না ওঠে।
আমাদের সর্বপ্রচেষ্টা, সর্বঅর্থব্যয়, সর্বসাধন, সম্পূর্ণ নিষ্ফল হবে যদি আমরা আমাদের সর্বপরিকল্পনা সর্বপ্রচেষ্টা জনগণের বোধ্য ভাষায় তাদের সম্মুখে প্রকাশ না করি। এ বিষয়ে আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই।
আমি জানি, ভারতবর্ষ এগিয়ে যাবেই, কেউ ঠেকাতে পারবে না। শুধু যারা অন্তহীনকাল ধরে ইংরেজির সেবা করতে চান, তারা ভারতের অগ্রগামী গতিবেগ মন্থর করে দেবেন মাত্র।
এ বিশ্বাস না থাকলে আমি বার বার নানা কথা এবং একাধিকবার একই কথা বলে বলে আপনাদের বিরক্তি ও ধৈর্যচ্যুতির কারণ হতুম না। –রায় পিথৌরা
.
তোমার আসন পাতব কোথায়?
মিশরের লোক নিশ্চয়ই বাঙলা পড়তে পারে, অন্তত মিশরস্থ ভারতের রাষ্ট্রদূত এ. এ. এ. ফৈজি সাহেব পারেন, এবং সত্যযুগ কাগজখানারও কিছুটা কাটতি কাইরোতে আছে। তা না হলে এ অলৌকিক ঘটনা ঘটল কী প্রকারে?
মিশর থেকে খবর এসেছে, ফৈজি সাহেবের উদ্যোগে কাইরোতে একটি মিশর-ভারত সংস্কৃতি-সঙ্ স্থাপিত হয়েছে। এই জাতীয় সঙ্ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অধম কোনও প্রকারের প্রস্তাব করেননি বটে কিন্তু স্মৃতি-বিলাস পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অধম রুদ্ধ-বাতায়ন এবং খোলা-জানালায় লিখনে কিছুটা ওকালতি করেছিল।
ভুবন-ব্যাপী রাজনৈতিক অরাজকতার মাঝখানে আমার নস্য-প্রমাণ লিখন দুটি এরকম ঝটপট ফল দেবে সে আশা আমি কস্মিনকালেও করিনি। তার শতাংশের একাংশও মনে মনে পোষণ করলে আমি আজই চিনির অনটন সম্বন্ধে গণ্ডদশেক প্রবন্ধ লিখতুম। তাই আমার এ কেরামতিটা কাকতালীয় বলে স্বীকার করে নেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত বলে বিবেচনা করলুম।
ফৈজি সাহেবকে পূর্ব-ভারতের লোক চেনে না। ইনি বোম্বাইবাসী এবং বোম্বাইয়ের ইসলামিক রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা। উৎকৃষ্ট আরবি জানেন এবং বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি-বিভাগ এরই আদেশ-উপদেশ অনুসারে চলে। শিয়াদের ইসমাইলিয়া সম্প্রদায় সম্বন্ধে তিনি বিস্তর গবেষণা করেছেন এবং অন্যান্য নানা বিষয়ে ইনি সুপণ্ডিত। চিন্তা-জগতে ইনি প্রগতিশীল, এবং চোস্ত আদব-কায়দা জানেন বলে ইনি রাষ্ট্রদূত বা ইচি হওয়ার উপযুক্ত।
কেউ যদি সঙ্কীর্ণমনা, প্রাদেশিক বাঙালি বলে আমার প্রতি কটুবাক্য প্রয়োগ না করেন তবে অবশ্য নিবেদন করব, আমাদের খুদাবখশ অথবা আব্দুল্লা সুহ্রাওয়ার্দীর তুলনায় ইনি এমন কিছু ভয়ঙ্কর গুণী নন। আজ আব্দুল্লা বেঁচে থাকলে তিনিই যে এ কর্মের সর্বোত্তম অধিকারী হতেন সে-বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু থাক্ এসব কথা, বাঙালি হিন্দুই যখন আজ বাঙলার বাইরে কোথাও কল্কে পায় না তখন আর মুসলমানের জন্য কোন্ কারবালায় কান্না জুড়ব? আব্দুল্লা অবশ্য কোনও অবস্থাতেই ফিরে আসবেন না, কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য সুধীও আছেন।
সংস্কৃতিকেন্দ্রের পত্তন উপলক্ষে মিশরের পক্ষ থেকে দু জন পণ্ডিত বক্তৃতা দেন। তার একজন অল-অজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গুরু বা শেখ।
সিদনা (সম্মানিত) শেখ যে অজহরের পক্ষ থেকে এ-উৎসবে যোগদান করেছেন সে বড় আনন্দের বিষয়। অজহর পৃথিবীর সবচেয়ে বুড়া বিশ্ববিদ্যালয়– তার বয়স এক হাজার সাতের কাছাকাছি। ইয়োরোপের তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়– তা সে অক্সফোর্ডই হোক আর প্যারিসই হোক–অজহরের হাঁটুর বয়সী এবং গোড়ার দিকে এদের সকলেই অজহরের নকল করত। ইবনে রুশদের (দার্শনিক আডেরস) যেসব বই অজহরে পড়ানো হত তারই লাতিন তর্জমা নিয়ে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়ানো আরম্ভ হয়। অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজের ছেলেরা যে গাউন পরে সেটি প্রথম থেকেই চালু করা হয় অজহরের অনুকরণে।
মক্কা যেরকম মুসলিম-জাহানের ধর্মকেন্দ্র, অজহর ঠিক সেইরকম মুসলিম-জাহানের শিক্ষাকেন্দ্র। অজহরের সিদনা শেখ যে বাণী বলেন, যে ফতোয়া দেন (এ-স্থলে ফতোয়া আমি শব্দার্থে অর্থাৎ বিধান অনুশাসন অর্থে ব্যবহার করছি) তামাম পৃথিবীর মুসলমান সে ফতোয়া পালন করার চেষ্টা করে। মিশরের প্রধানমন্ত্রীর তো কথাই নেই, স্বয়ং রাজা পর্যন্ত এঁকে সমঝে চলেন।
সিদনা শেখ কেন্দ্রের উন্নতিকল্পে নানা প্রস্তাব পেশ করে কামনা জানিয়েছেন, মিশর-ভারতে যেন ছাত্র ও শিক্ষক বিনিময় হয়। ভারত সম্বন্ধে মিশরের কৌতূহল প্রচুর তাই তিনি ভরসা রাখেন এইসব শিক্ষক ও ছাত্র ভারতবর্ষ থেকে ফিরে গিয়ে আরবি ভাষায় ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কেতাব লিখে মিশরবাসীর জ্ঞান বাড়াতে সমর্থ হবেন।