বিবেচনা করিয়া দেখিলাম, আরব লেখকের কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য।
গত শনি, রবি, সোমবারে বোম্বাই বাজারে যে তুমুল কাণ্ড দেখিলাম, তাহাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ আর রহিল না।
একশত হইতে উপরের নোট আর যত্রযত্র ভাঙানো যাইবে না খবর প্রকাশ হওয়া মাত্র কালোবাজারিদের হৃদকম্প উপস্থিত হইল। ফালতু ট্যাক্স হইতে আত্মত্রাণ করিবার জন্য ব্যবসায়ীরা বিস্তারে বিস্তরে একশত, এক হাজার টাকার নোট গৃহে লোহার সিন্দুকে জমায়েত করিয়া রাখিয়াছিল, সে টাকা লইয়া তাহারা করিবে কী?
তখন কালোবাজারিরা ছুটিল ব্যাংকারদের কাছে। দয়া করিয়া, ঘুষ লইয়া নোটগুলি লও, হিসাবে দেখাও যে বহুদিন ধরিয়া এই নোটগুলি তোমাদের ব্যাংকে জমা ছিল। আমরা বাঁচি। ব্যাংকারদের জেলের ভয় আছে; কাজেই পন্থা বন্ধ।
কেহ ছুটিল সোনার বাজারে। সে বাজারে এমনি হিড়িক লাগিল যে, দাম হুশ হুশ করিয়া গগনস্পর্শী হইতে লাগিল। কর্তারা সোনার বাজার বন্ধ করিয়া দিলেন।
কেহ ছুটিল তাড়া তাড়া নোট পকেটে করিয়া শরাবের দোকানে। এক টাকার মদ খাইয়া একশত টাকার নোট ভাঙাইবার চেষ্টা করে। আমি গিয়াছিলাম এক বোতল সোডা খাইতে, দোকানি সোড়া দিবার পূর্বে সন্তর্পণে কানে কানে প্রশ্নবাণে প্রাণ হানে, একশত টাকার নোট নয় তো স্যার? ভাঙানি নাই।
বিস্ময় মানিলাম। প্রায় ছয় মাস হইল আমার মতো কারবারি-বুদ্ধি-বিবর্জিত মূর্খও বিলাতি মাসিকে পড়িয়াছিল যে, ইংলন্ডে কালোবাজারের ফাঁপানো পয়সাকে কাবুতে আনিবার জন্য দশ পৌন্ড নোটের উপর কড়া আইন চালানো হইয়াছে। সেই মাসিক কি এদেশের কারবারিরা পড়ে নাই। পড়িয়া থাকিলে ছোট নোটে ভাঙাইয়া রাখিলেই পারিত।
আরব ঠিকই বলিয়াছিলেন, ধনীরা পুস্তক (এমনকি মাসিক কাগজও) পড়িতে জানে না।
.
০৫.
বাঙলা ভাষায় একখানা অতি উপাদেয়, গ্রন্থ আছে। বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্রের কথা স্মরণ করিতেছি। কী অসাধারণ পরিশ্রম, কী অপূর্ব বিশ্লেষণ, অবিমিশ্র যুক্তিতর্কের কী অদ্ভুত ক্রমবিকাশ এই পুস্তকে আছে, তাহা বর্ণনা করিয়া শেষ করা যায় না। ভাষা ও শৈলী সম্বন্ধে শুধু এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, যুক্তিতর্কপূর্ণ রচনায় এই ভাষাকেই আজ পর্যন্ত কেহই পরাজিত করিতে পারেন নাই। অনেকের মতে বাংলা গদ্য রচনায় কৃষ্ণচরিত্রের পর উল্লেখযোগ্য কোনও উন্নতি হয় নাই।
আরেকটি বিষয় লক্ষ করিয়া বিস্ময় মানিতে হয়। বঙ্কিম কয়েক জর্মন পণ্ডিতের নাম এই পুস্তকে উল্লেখ করিয়াছেন এবং সেই যুগে প্রত্যেকের নামের শুদ্ধ উচ্চারণ জৰ্মনে কী সে খবর লইয়া বাঙলায় বানান করিয়াছেন। আমরা নির্বিকার চিত্তে নিত্য নিত্য জওহরলাল, প্যাটেল, মালব্য লিখি, পটোডির নওয়াব ও ভিনু মনকদের কথা আর তুলিলাম না।
সে কথা থাকুক। কিন্তু বঙ্কিমের পুস্তকখানা বাঙলায় লেখা, বাঙলা লিপিতে। যদি পুস্তকখানা দেবনাগরী অক্ষরে লিখিত হইত, তবে বহু অবাঙালি অনায়াসে ইহা পড়িয়া উপকৃত হইতে পারিতেন।
পাঠক পত্রপাঠ শুধাইবেন বাঙলা, হিন্দি, গুজরাতি, মারাঠিতে কি এতই সাদৃশ্য যে শুধু ভিন্ন লিপি বলিয়া, এক প্রদেশের লোক অন্য প্রদেশের রচনা পড়িতে পারে না?
দৃষ্টান্ত স্বরূপ নিম্নলিখিত রচনাটি পাঠ করুন।
ব্যায়ামচর্চা ভারত অতি পুরনি কালরে পরা প্রচলিত; অসমতো নতুন নহয়। অহোম রাজা সকলর দিনত অসমত ব্যায়ামর খুব আদর আছিল। বিশেষকৈ মহারাজ রুদ্ৰসিংহর দিনত ইয়ার প্রসার বেচী হয়। তেঁও অসমর জাতীয় উৎসব আদিত ব্যায়ামর দৃশ্য দেখুবার নিয়ম করিছিল।
একখানা আসামি পুস্তিকা হইতে এই কয়টি পঙক্তি তুলিয়া দিলাম: ইহার বাংলা অনুবাদ করিয়া সহৃদয় সরল পাঠককে অপমানিত করিতে চাহি না। যে লিপিতে লেখা হইয়াছে অক্ষরে অক্ষরে সেইরকম তুলিয়া দিলাম; কেবলমাত্র বক্তব্য যে র অক্ষর আসামিতে ক অক্ষরের পেট কাটিয়া করা হয় এবং ওয়া উচ্চারণ প্রকাশ করিতে হইলে ব অক্ষরের উপরে একটি হসন্ত জাতীয় চিহ্ন ব্যবহৃত হয়।
এই কয়টি পঙক্তিই যদি কোনও বিজাতীয় লিপিতে লেখা হইত, তবে এ ভাষা যে না। শিখিয়াও পড়া যায়, সে তত্তটুকু শিখিতে আমাদের মতো অনভিজ্ঞের এক যুগ কাটিয়া যাইত।
পুনরায় দেখুন :
ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক উন্নতি রাজনৈতিক স্বাধীনতার উপর নির্ভর করে বাক্যটি হিন্দিতে ভারতবর্ষকী অর্থনৈতিক উন্নতি রাজনৈতিক স্বাধীনতা পর নির্ভর করতি হৈ, এবং গুজরাতিতে ভারতবর্ষনী অর্থনৈতিক উন্নতি রাজনৈতিক স্বাধীনতা পর নির্ভর করে ছে বলিলে বিশেষ ভুল হয় না কিন্তু যেহেতু গুজরাতি ও হিন্দি ভিন্ন লিপিতে লেখা হয়, আমরা এইসব ভাষা দূরে রাখি; ওইসব ভাষা-ভাষীরাও একে অন্যের মধ্যে তাহাই করেন।
এই বাক্যটিই ফরাসিতে বলি :
le progres economique de l Indedepend sur son Independance politique.
লিপি একই, অর্থাৎ ইংরেজি; কাজেই ভাষাশিক্ষা ব্যাপারে অতি অথর্ব ইংরেজও তাড়াতাড়িতে ফরাসি শিখিতে পারে।
তাহা হইলেই প্রশ্ন, তাবৎ ভারতবর্ষে একই লিপি প্রচলিত হইলে ভালো হয় কি না?
তাহা হইলে পুনরায় প্রশ্ন– শান্তিনিকেতন হইতে শ্ৰীযুত সেন মহোদয় জিজ্ঞাসা করিতেছেন তাবৎ পৃথিবীর জন্য একই লিপি হইলে ভালো হয় কি না? অর্থাৎ লাতিন লিপি যে লিপিতে লাতিন, ইংরেজি, ফরাসি, ইতালীয়, স্পেনীয়, পর্তুগিজ, তুর্কি ও অধিকাংশ জর্মন পুস্তক লেখা হয়।