সংস্কৃতই যে জানিতে হইবে এমন কোনও কথা নহে। ইংরেজি ফরাসি বা আরবি যে কোনও সাহিত্যের সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ যোগ থাকিলেই ভাষা ও সাহিত্যের মাপকাঠি পাওয়া যায়।
আধুনিক বঙ্গসাহিত্য না পড়িলে মনে হয় অধিকাংশ লেখকেরা যেন শুধু বাঙলার পুঁজিই ভাঙাইয়া খাইতেছেন। কিন্তু এককালে তো এরকম ছিল না। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, সকলেই যে শুধু সংস্কৃতে পণ্ডিত ছিলেন তাহা নহে, তাহারা সকলেই ইংরেজি বেশ ভালো করিয়া জানিতেন।
ভারতচন্দ্র ফারসি ও সংস্কৃত দুই ভাষাই জানিতেন, এবং কী প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ যে তাহার আয়ত্তাধীন ছিল ও মোগল বিলাসের যে কী সন্ধান তিনি রাখিতেন তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ হইতে প্রকাশিত ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলীর প্রথম খণ্ড ১৭/১৮ পৃষ্ঠা পশ্য।
(এস্থলে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করি, সাধারণ বাঙালি পাঠক এই দুই পৃষ্ঠায় উল্লিখিত তাবৎ আরবি শব্দ বুঝেন? না ইহাদের অর্থ দ্বিতীয় খণ্ডে প্রকাশিত হইবে– আমার কাছে দ্বিতীয় খণ্ড নাই।)।
যে কবি অত্যন্ত সহজ সরল অনুভূতি গীতিকাব্যে প্রকাশ করিতে চাহেন তাহার জন্য হয়তো সংস্কৃতের প্রয়োজন নাই। চণ্ডীদাসের সংস্কৃত জানিবার প্রয়োজন নাই; জসীম উদ্দীন চসার শেক্সপিয়র পড়িয়াছেন কি না সে প্রশ্ন অবান্তর।
যাহারা জটিল নভেল লেখেন ও উপন্যাস রচনা করেন তাঁহাদের সম্বন্ধেই উপরের মন্তব্যগুলি করিলাম।
.
০৩.
আমরা সাধারণত যখন ইউরোপে বা ইউরোপীয় সভ্যতা সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করি, তখন প্রায়ই ভুলিয়া যাই যে ইউরোপ সম্বন্ধে আমাদের প্রায় সকল জ্ঞান ইংরেজি পুস্তক হইতে সঙ্কলিত এবং ইংরেজিতে যেসব ফরাসি-জর্মন ইত্যাদি গ্রন্থ অনূদিত হয়, সেগুলি প্রায়শ ইংরেজ মনকে দোলা দিয়াছে বলিয়াই ওই ভাষাতে রূপান্তরিত হইয়াছে। অর্থাৎ বহুস্থলে সেগুলি খাস ফরাসি-জর্মন নহে, ইংরেজকে খুশি করিতে পারিয়াছে, ঈষৎ ইংরেজ-ভাবাপন্ন বলিয়া।
অথচ ইংরেজ ও ফরাসি যে কী ভীষণ দুই পৃথক জাত সে সম্বন্ধে অন্তহীন আলোচনা চলিতে পারে। সাহিত্যের দিক দিয়া দেখিতে গেলে নির্ভয়ে বলা যায় ফরাসি সাহিত্য ইংরেজি হইতে বিশেষ কিছু গ্রহণ করে নাই, কিন্তু ইংরেজি পদে পদে ফরাসির হাত ধরিয়া চলিয়াছে। তামাম ফরাসি ভাষাতে একশতটি ইংরেজি শব্দ খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না; ইংরেজিতে শুধু ফরাসি শব্দ নহে, গোটা বাক্য বিস্তরে বিস্তরে আছে। ইংরেজের পোশাকি রান্না বলিয়া কোনও বস্তু নাই– দ্র খাবারের মেনু মাত্রই আগাগোড়া ফরাসিতে লেখা। এমনকি ভিয়েনার ভিনার মিসেল পর্যন্ত ইংরেজি মেনুতে ফরাসির মধ্যস্থতায় এসূকেলপ দ্য ভ্য আ লা ভিয়েনেয়াজ রূপে পৌঁছিয়াছে।
ইংরেজি সঙ্গীত বলিয়া কোনও বস্তু নাই– যাহা কিছু তাহার শতকরা ৯৯ ভাগ জর্মন-ফরাসি-ইতালীয়-রুশ। তামাম বৎসর চালু থাকে এরকম অপেরাগৃহ একটিও লন্ডনে নাই; উত্তম অপেরা শুনিতে হইলে ড্রেসডেন যাও, মুনিক যাও, বন্ যাও, ভিয়েনা যাও, প্যারিস যাও।
ইংরেজ মেয়ে ফ্রক ব্লাউজ কিনিতে প্যারিস যায়, ছবি আঁকা শিখিতে প্যারিস যায়, ভাষা শিখিতে প্যারিস যায়, উৎকৃষ্ট খাদ্য ও মদ্য আস্বাদ করিতে প্যারিস যায়, বোতল বোতল বর্দো-বার্গন্ডি-শ্যাম্পেন খরিদ করিয়া নৌকা বোঝাই করিয়া ইংলন্ডে লইয়া যায়– ফরাসি স্কচ-হুঁইস্কি খাইতেছে আর মারোয়াড়ি পাঠার কালিয়া খাইতেছে– একই কথা।
ফরাসি ইংরেজকে বলে চরুয়া অর্থাৎ চরের বাসিন্দা অর্থাৎ খানদানহীন ঔপনিবেশিক। পদ্মার পারের জমিদার পদ্মার চর-বাসিন্দাকে যেরকম অবহেলা করে, ভাবে– চর আজ আছে কাল নাই– খানদানের বনিয়াদ গড়িবে কী প্রকারে, ফরাসি ইংরেজ সম্বন্ধে সেইরকম ভাবে। চ্যানেল পার হইয়া তাহাকে লন্ডন যাইতে হইলে, তাহার মস্তকে সহস্র বজ্রাঘাত হয়।
উপযুক্ত মন্তব্যগুলি করার উদ্দেশ্য এই যে, আমরা যেন ইউরোপের তাবৎ কর্মকীর্তি ইংরেজের জমার খাতায় লিখিয়া তাহাকে অহেতুক ভক্তি না দেখাই। দ্বিতীয়ত, ফরাসি ও জর্মন পড়াইবার ব্যাপক ব্যবস্থা যেন এদেশের স্কুল-কলেজে করা হয়। আমাদের মনে হয় কলকাতার ছেলেরা এককালে যেটুকু ফরাসি-জর্মন শিখিত এখন যেন সেইটুকুও শিখিতেছে না।
আমাদের স্কুল-কলেজে কী বিকট আনাড়ি কায়দায় ভাষা শিখানো হয় তাহার বিস্তৃত আলোচনা আরেকদিন করিবার বাসনা রহিল। উপস্থিত শুধু বলি চারি বৎসর স্কুলে ও চারি বৎসর কলেজে সংস্কৃত অথবা ফারসি পড়ার পরও ছাত্র ওইসব ভাষাতে সড়গড় হয় না এমন অদ্ভুত ব্যাপার আমি কোনও সভ্য দেশে দেখি নাই শুনি নাই।
.
০৪.
এক প্রসিদ্ধ আরব লেখকের স্বগত পড়িতেছিলাম।
ধনীরা বলে, অর্থোপার্জন করা কঠিন, জ্ঞানার্জনের অপেক্ষাও কঠিন। পণ্ডিতেরা বলেন, জ্ঞানার্জন অর্থোপার্জনের অপেক্ষা কঠিন; অতএব জ্ঞানীরা ধনীর চেয়ে শক্তিমান ও মহৎ। আমি বিস্তর বিবেচনা করিয়া এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছি যে, আমরা– অর্থাৎ জ্ঞানীরা যদি কখনও অর্থ পাই, তবে সে অর্থ ব্যয় করিতে সক্ষম এবং অনেক সময় ধনীদের চেয়েও সৎপথে অর্থ ব্যয় করি, কিন্তু ধনীরা যখন আমাদের সম্পদ অর্থাৎ পুস্তকরাজি পায়, তখন সেগুলির ব্যবহার বিলকুল করিতে পারে না। অতএব সপ্রমাণ হইল জ্ঞানীরা ধনীর চেয়ে শক্তিমান।