***
যতদূর মনে পড়িতেছে ১৯৩২ সালে কাছাড় লর্ড বেনটিঙ্কের সময় ইংরেজ কর্তৃক অধিকৃত হয়। তাহার পর একশত বৎসর কাটিয়াছে। ধীরে ধীরে ইংরেজ গারো, লুসাই, নাগা অঞ্চলে আপন ডেরা ফেলিয়া ফেলিয়া দখল বাড়াইয়া চলিয়াছেন। ইহাদের জন্য ইংরেজ সরকার কী উপকার করিয়াছেন তাহার ইতিহাস লিখিবার সময় আজও হয় নাই। মোগল পাঠানরা ইহাদের রাজত্ব দখল করেন নাই, ইহাদের প্রতি কোনও দায়িত্ব তাঁহাদের ছিল না। কিন্তু ইংরেজ সরকারকে একদিন উভয়ার্থে আসামি ঐতিহাসিক গবেষণার কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া স্বপক্ষ সমর্থন করিতে হইবে।
মধ্য আফ্রিকার বনেজঙ্গলে হস্তীদন্ত-ব্যবসায়ী মুসলমান ইসলাম প্রচার করেন, বেতনভোগী ইউরোপীয় মিশনারিরা খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেন। নিগ্রো মুসলমানদের কথা আজ থাক, কিন্তু খ্রিস্টান নিগ্রোদের কী অবস্থা হইয়াছে তাহা বার্নার্ড শর কৃষ্ণার ব্রহ্মান্বেষণ পুস্তকে পাইবেন। অসভ্য সুরা-অনভ্যস্ত জনগণের ভিতর মদ্য চালাইলে কী নিদারুণ কুফল হয় ও সেই সুযোগ লইয়া বিবেকধর্মহীন পুঁজিপতিরা তাহাদের কী অনিষ্ট করে, তাহা আঁদ্রে জিদের বেলজিয়ম কঙ্গো পুস্তকে পাঠক পাইবেন। ও অন্যান্য নিরপেক্ষ লেখকের অধুনা-খ্যাতিপ্রাপ্ত ফরাসি ডাকার অঞ্চলের বর্ণনায় পাইবেন।
***
খ্রিস্টান মিশনারিরা লুসাই, গারো, খাসিয়া ও নাগা অঞ্চলে প্রবেশ করেন। সরকারের কতটা সাহায্য পান ঠিক বলিতে পারি না, কিন্তু অনুমান করি ভারতবর্ষে ও পৃথিবীর অন্যত্র মিশনারিরা সচরাচর যে সাহায্য লাভ করেন, তাহাই পাইয়াছিলেন। অধুনা মুসলমানরা খাসিয়া পাহাড়ে ইসলাম প্রচারে লিপ্ত হইয়াছেন ও ব্রাহ্মরা কিয়ঙ্কাল ওইস্থলে ধর্মপ্রচারের পর কয়েকটি পরিবারকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত করেন। তুলনামূলক ধর্ম সম্বন্ধীয় আলোচনা বারান্তরে হইবে; উপস্থিত শুধু এইটুকু বলিতে চাই যে, যে কোনও মানুষ যে কোনও ধর্ম গ্রহণ করুক আপত্তি নাই, কিন্তু যে ধর্মান্তর গ্রহণে সাহায্য করে সে যেন ঠিক এইটুকু বোঝে যে, ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে তাহাকে সে অর্থনৈতিক, সামাজিক, বেশভূষা, আহার-বিহার সংক্রান্ত, দেশের অবস্থার সঙ্গে খাপ না খাওয়া, ছন্নছাড়া কোনও নতুন ক্ষতিকর পরিবেষ্টনীতে যেন টানিয়া লইয়া না যায়।
বাঙালি মুসলমান আরব বেদুইনের ন্যায় কাবাব-গোস্ত খায় না, রাইফেল লইয়া দল বাঁধিয়া হানাহানি করে না, কিন্তু এক জর্মন নৃতত্ত্ববিদ খ্রিস্টান নাগাদের নতুন সামাজিক জীবনের সঙ্গে বসবাস করিয়া তাহাদের প্রচুর নিন্দা করিয়াছেন। কোনও কোনও পার্বত্য অঞ্চলে স্বচক্ষে কড়া মদের মাতলামি দেখিয়াছি ও বিশ্বস্তসূত্রে শুনিয়াছি কোনও কোনও অঞ্চলে গোপন বেশ্যাবৃত্তি আরম্ভ হইয়াছে।
কিন্তু সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ভয়, এইসব খ্রিস্টানরা যেন আসামের চা-বাগিচার খ্রিস্টান ম্যানেজারদের সঙ্গে জুটিয়া এক নতুন ক্রিশ্চান লিগ নির্মাণ না করে। ট্রাইবেল লিগ হউক, আমরা তাহার মঙ্গল কামনা করিব, কিন্তু ক্রিশ্চান লিগ করিলে পার্বত্য জাতিরা আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে।
.
০২.
উচ্চারণ সম্বন্ধে আর বাক্যবিনাস করিব না, এই প্রতিজ্ঞা করিলাম। কিন্তু তৎপূর্বে শেষবারের মতো একখানি চিঠি হইতে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিব। হাজরা লেন হইতে শ্রীমতি ঘোষ লিখিতেছেন :
আমার ধারণা, অল্প একটু চেষ্টা করলেই বাঙালির সংস্কৃত উচ্চারণ বিশুদ্ধতায় যে কোনও ভারতীয় পণ্ডিতের সমকক্ষ হতে পারবে। প্রমাণস্বরূপ একটা উদাহরণ দিতে পারি– যদিও সেটি এত তুচ্ছ যে বলতে সংকুচিত হচ্ছি। পাঞ্জাবি অধ্যাপকটির ক্লাসে আমরা যে কয়টি ছাত্রী ছিলাম, তাহাদের মধ্যে তিনি বাঙালির উচ্চারণে কখনও কোনও ভুল তো ধরেনইনি; এমনকি সময়ে সময়ে একটু বেশি প্রশংসা করতেন। (লেখিকা দিল্লি কলেজে পড়িতেন।)
সর্বশেষ লেখিকার বক্তব্য–
যদি কলকাতার স্কুলগুলোর সংস্কৃত শিক্ষকেরা এ বিষয়ে একটু অবহিত হন, তা হলে বোধহয় কিছু সুফল পাওয়া যেতে পারে।
সবিস্তার মন্তব্য অনাবশ্যক। শুদ্ধ উচ্চারণ শিক্ষা যদি সত্যই কঠিন না হয়, তাহা হইলে এই স্থলে উচ্চারণ সম্বন্ধে আলোচনা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বন্ধ করা যাইতে পারে।
***
আমরা যখন সংস্কৃত শিখি, আরবি-ফারসি শিখি, তখন আমাদের উদ্দেশ্য এই নহে যে, সংস্কৃত অথবা আরবিতে সাহিত্যসৃষ্টি করিব। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য উৎকৃষ্ট সাহিত্য পড়িয়া হৃদয়মনকে সংস্কৃত ও ধনবন্ত করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ওইসব সাহিত্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া, উহাদের পরশমণি দ্বারা যাচাই করিয়া করিয়া মাতৃভাষায় উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচনা করা। উদাহরণরূপে বলিতে পারি যে, রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃত না জানিলে যৌবন বেদনা রসে উচ্ছল আমার দিনগুলি কবিতাটি লিখিতে পারিতেন না, প্রমথ চৌধুরী উত্তম ফরাসি ও বিশেষত আনাতোল ফ্রাঁস না পড়িলে কখনও বাংলাতে নতুন শৈলী প্রবর্তন করিতে পারিতেন না।
ইংরেজি, ফরাসি, জর্মন সাহিত্য আজ এত সমৃদ্ধ যে গ্রিক-লাতিনের জ্ঞান না থাকিলেও ইহাদের যে কোনও ভাষাভাষী মাতৃভাষার সাতজন ভালো লেখকের শৈলী মিশ্রণ করিয়া নতুন সৃষ্টি করিতে পারে; বিষয়বস্তু অনুসারে গড়িয়া পিটিয়া নতুন ঢং তৈয়ারি করিতে পারে। কিন্তু বাঙলাভাষা এখনও অত্যন্ত অপকু, সাহিত্য বড়ই দরিদ্র।