(২) কেন্দ্র বাংলা উন্নয়ন বোর্ড।
আপনারা বাঙালদের যত মূর্খ ভাবেন তারা অতখানি মূর্খ নয়। তারা তখন অন্য প্যাঁচ কষল। তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে জানাল, আমাদের পাঠশালা স্কুলে যেসব টেকস্ট বই পড়ানো হচ্ছে সেগুলো বড়ই অনৈসলামিক ভাবাপন্ন। অতএব সেগুলো নাকচ করে দিয়ে নয়া নয়া কেতাব লেখা হোক। গাড়োল রাওলপিণ্ডি সে ফাঁদে পা দিল। তখন সৃষ্ট হল কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু ইয়া আল্লা ইয়া রাসুল! কোথায় না তারা প্রস্তাবিত কর্মে লিপ্ত হবে, না তারা লেগে গেল বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের পরিপূর্ণ পদ্য-গদ্য রচনা সম্পূর্ণাকারে প্রকাশ করতে। আমার মনে হয়, তখনই তারা ভিতরে ভিতরে আপন অজান্তে জেনে গেছে, ঝঞ্ঝা আসন্ন, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে একটা দফারফা করতেই হবে। অতএব বিদ্রোহী কবি কাজীই আমাদের ভরসা। কী সুন্দর তিন ভলুম এ্যাবৎ বেরিয়েছে। যিনি সম্পাদনা করেছেন তার নাম বলব না। পাছে না টিক্কা খানের লোক তাকে গুলি করে মারে। (টিক্কা অর্থ টুকরো–ফারসিতে বলে টিক্কা টিক্কা মি কুন –তোকে টুকরো টুকরো করব। আমরা যেরকম তিনকড়ি, এককড়ি, ফকির নফর নাম দিই যাতে করে যম তাকে না নেয়।)
(৩) এশিয়াটিক সোসাইটি অব্ ইস্ট পাকিস্তান স্থাপিত হল। (ঠিক কী নাম বলতে পারছিনে।) এতেও পশ্চিম পাকের খানরা চটে গেলেন। কারণ বাঙালরা তখন বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার ময়নামতি-লালমাই (এই ময়নামতি অঞ্চলেই এখন লড়াই চলছে) যেসব স্থলে বৌদ্ধবিহার স্থাপিত ছিল, যে সবের বর্ণনা চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং দিয়েছেন, সেই নিয়ে তারা লেকচর দিচ্ছে, সেমিনার করছে। তোবা, তোবা।
(৪) এবং এসবের বহু পূর্বেই আবদুল হাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃতের প্রধানতম অধ্যাপক, তাঁর সাংস্কৃতিক ত্রৈমাসিক বের করে যাচ্ছেন। এবং তিনি প্রকাশ করলেন তাঁর ওই পত্রিকায় আমাদের পশ্চিম বাংলার হরেন পাল মহাশয়ের অভিধান।
এই চতুরঙ্গে বাঙাল দেশ তার আপন পথে এগিয়ে যাচ্ছিল রাজনীতিকে উপেক্ষা করে। এমন সময় ইয়াহিয়া খান মারলেন ওই প্রগতির উপর থাপ্পড়। এর উত্তরে আমরা শুধু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে পারি।
বাহুর দম্ভ, রাহুর মতো,
একটু সময় পেলে
নিত্যকালের সূর্যকে
সে এক-গরাসে গেলে।
নিমেষ পরেই উগরে দিয়ে
মেলায় ছায়ার মতো,
সূর্যদেবের গায়ে কোথাও
রয় না কোনও ক্ষত।
বারে বারে সহস্রবার হয়েছে এই খেলা,
নতুন বাহু ভাবে
তবু হবে না মোর বেলা
কাণ্ড দেখে পশুপক্ষী।
ফুকরে ওঠে ভয়ে,
অনন্তদেব শান্ত থাকেন
ক্ষণিক অপচয়ে।
.
হ-য-ব-র-ল
০১.
তথাকথিত পণ্ডিতেরা বলেন, আসাম দেশ অসমান বলিয়া ইহার নাম আসাম। অথচ আদি বাসিন্দাদের নাম অহম। ইহাদের নামেই দেশের নাম হওয়া উচিত অহম দেশ। প্রকৃত তত্ত্ব এই যে, আসাম হইতে অহম হয় নাই, অহম হইতে আসাম হইয়াছে। ফোক ফিললজিস্ট অর্থাৎ গাঁওবুড়ো শব্দতাত্ত্বিক মনে মনে তর্ক করিয়াছেন যে, যেহেতু শুদ্ধ বাঙলার সেপার পূর্ব বঙ্গে হেপার, সাগর হাওর, সরিষা হইরা হয়, অতএব উল্টা হিসাবও চলে– অর্থাৎ স যখন হ হইতে পারে তখন হ-ও স হইতে পারে। এই নীতি চালাইলে যে হাসানো আর শাসানো একই ক্রিয়া হইয়া দাঁড়ায়, গাঁওবুড়ারা তাহা খেয়াল করিলেন না। স্থির করিলেন অহমই অসম; তার পর অসম হইতে আসাম হইল। তখন তথাকথিত পণ্ডিতেরা আসিয়া সমাধান করিলেন, এই দেশ অসমান বলিয়া ইহার নাম আসাম।
গাঁওবুড়াদের মূর্খ বলিলে আমাদের অন্যায় হইবে। উল্টাপুরাণ যে সর্বত্র চলে না– এ জ্ঞান এখনও বহু নাগরিকের হয় নাই। সায়েবরা হ্যাটকোট পরেন অতএব হাটকোট পরিলেই সায়েব হইয়া যাইব গায়িকা সুন্দরী কাননবালা লম্বা হাতা জামা পরেন অতএব লম্বা হাতা জামা পরিলে গায়িকা ও সুন্দরী হওয়া যায় এই ভুল যুক্তিজনিত আচার তো হাটে-ঘাটে ট্রামে-বাসে সর্বত্র দেখা যায়।
***
এই আসাম হইতে প্রত্যাগত এক বন্ধু বলিলেন যে, এতদিন আসামে যে তিন দলে রাজনৈতিক রেষারেষি চলিত তাহার সঙ্গে এখন চতুর্থ দল আসিয়া জুটিয়াছে। এই তিন দলের প্রথম দল আসামি বা অসমিয়া (উচ্চারণ অহমিয়া); ইঁহারা আসামি ভাষায় কথাবার্তা বলেন। আসামি ভাষা ও বাংলায় পার্থক্য ওড়িয়া বাঙলা অপেক্ষাও কম; আসামিদের গায়ে আর্য ও অহম রক্তের সংমিশ্রণ, যেরকম বাঙালির ধমনিতে আর্য ও মঙ্গোল দ্রাবিড় রক্তের সংমিশ্রণ। দ্বিতীয় দল শ্রীহট্ট, কাছাড়, গোয়ালপাড়ার অধিবাসী বাঙালি। ইঁহারা মূলত বাঙলা দেশেরই লোক, ইহাদের বাসভূমি বাঙলা দেশ হইতে কর্তন করিয়া আসামে জুড়িয়া দেওয়া হইয়াছে এবং ইহাদের অনেকেই চাহেন যে, ওইসব জিলাগুলো যেন পুনর্বার বাঙলা দেশে ফিরাইয়া লওয়া হয়। তৃতীয় দল বিশুদ্ধ অহম। ইঁহারা আসামের আদিম বাসিন্দা, হঁহাদের অনেকেই আর্যরক্ত দ্বারা অশুদ্ধ বা শুদ্ধ–যাহাই বলুন–না হইয়া আপন আভিজাত্য রক্ষা করিয়াছেন। চতুর্থ দল নতুন আসিয়া জায়গা চাহিতেছেন, ইঁহারা গারো, লুসাই, কুকি, নাগা, আবর, মিশমি ইত্যাদি পার্বত্য জাতি। ইঁহারা আসামের আদিমতম বাসিন্দা এবং আসামের রাজনৈতিক যজ্ঞশালায় উঁহারা এতদিন অপাঙক্তেয় ছিলেন।