সন্ধ্যাকালেই ভদ্রলোক খবর পাইলেন যে, তাহার নাম ভারত প্রত্যাগমনকামীদের নির্ঘণ্ট হইতে নাকচ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। খবরটি দিলেন ভদ্রলোকটির বন্ধু, ব্রিটিশ লিগেশনের অরিয়েন্টাল সেক্রেটারি, খান বাহাদুর শেখ মহবুব আলী খান, বন্ধুভাবে, সরকারি খবর হিসাবে নয়। তার পর সেইসব জাহাজে করিয়া ফরাসি গেল, জর্মন গেল, ইতালি গেল, তুর্ক গেল, ইরানি গেল, ব্রিটিশ লিগেশনের মেয়েরা গেলেন। তার পর সর্বশেষে ভারতীয় মেয়েদের খোঁজ পড়িল। তাঁহাদের অনেকেই পুরুষ অভিভাবক ছাড়া হাওয়াই জাহাজে চড়িয়া পেশোয়ার যাইবার হিম্মত পান না– কেহ কেহ গেলেন, কেহ কেহ রহিলেন। ভদ্রলোকটি রীতিমতো জোর-জবরদস্তি করিয়া রবীন্দ্রনাথের শিষ্য, (পরে) শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক স্বর্গীয় মৌলানা জিয়াউদ্দিনের স্ত্রীকে হাওয়াই জাহাজে তুলিয়া দিয়া আসিলেন। তার পর অতি সর্বশেষে ভারতীয় পুরুষদের পালা আসিল। কিন্তু ভদ্রলোকটির নামে তো ঢেরা পড়িয়াছে; তিনি পেটে কিল মারিয়া কাবুলের মাটি কামড়াইয়া পড়িয়া রহিলেন।
এদিকে ভারতবর্ষে ভদ্রলোকের পিতা-পুত্রের কোনও খবর না পাইয়া আহারনিদ্রা ত্যাগ করিয়াছেন ও টেলিগ্রাফ অফিসে থানা বাঁধিয়াছেন। দিল্লি-সিমলা যেখানে যাহাকে চিনিতেন, অহরহ তার করিতেছেন, আমার পুত্রের কী খবর? আসামের বর্তমান রাজস্বসচিব (?) মৌলবি আবদুল মতীন চৌধুরীও একখানা তার পাইলেন। সেইদিনই সর ডেনিস ব্রের সঙ্গে তাঁহার দেখা। ভোট সংক্রান্ত কী একটা ব্যাপারে সর ডেনিস মতীন সাহেবের কাছে যান। তিনি বলিলেন, তোমরা যে কাগজে ছাপাইতেছ ভারতীয়দের আনা হইতেছে, অমুকের খবর কী?
সর ডেনিস কাবুলে বেতার পাঠাইলেন সর ফ্রান্সিসকে, অমুককে তার-পাঠ পাঠাও। সাইমন কমিশন তখন আসিব-আসিব করিতেছে অথবা আসিয়াছে। সর ডেনিস সেন্ট্রাল এসেমব্লির সদস্যকে সস্তায় খুশ করিতে কেন নারাজ হইবেন। কোনও ভারতীয়কে বাঁচাইবার জন্য ওই একটিমাত্র বেতার সেই সময় ভারতবর্ষ হইতে কাবুল যায়! পেশাওয়ার সরকার ও কাবুলের ব্রিটিশ লিগেশনে বেতার চলিত, বলা বাহুল্য যে, সে-বেতারের সুবিধা ভারতীয়দের দেওয়া হয় নাই। কাবুলে বসিয়া ভদ্রলোক অবশ্য এসব খবর পান নাই।
সে-বেতার লিগেশনে কী অলৌকিক কাণ্ড বা তিলিসমাত করিল তাহা স্থানাভাবে বাদ দিলাম। পরদিন ভদ্রলোক খবর পাইলেন, তাহার জন্য আগামীকল্যের হাওয়াই জাহাজে একটি স্থান রিজার্ভ করা হইয়াছে। ফেবার না রাইট তাহার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আর হইল না।
সর্বস্ব কাবুলদস্যদের জিম্মায় ফেলিয়া মাত্র দশ সের (অথবা পৌন্ড) লগেজ লইয়া ভদ্রলোক হাওয়াই জাহাজে করিয়া পেশাওয়ার ফিরিলেন। বিমানঘাঁটিতে সর ফ্রান্সিস করমর্দন করিয়া বলিলেন, আমরা ভারতীয়দের যথাসাধ্য সাহায্য করিবার চেষ্টা করিয়াছি, আশা করি, আপনি ভারতবর্ষে ফিরিয়া সব কথা বলিবেন।
ভদ্রলোকটি বলিলেন, নিশ্চয়ই সব কথাই বলিব। দেশে ফিরিয়া তিনি জমিয়ত-উল উলেমার নেতা মৌলানা হুসেন আহমদ মদনীকে আদ্যোপান্ত বলেন। আন্দোলনও হইয়াছিল কিন্তু কোনও ফল হয় নাই। লিগেশন-কর্তা প্রমোশন পাইয়া ইরাক না কোথায় চলিয়া গেলেন।
বর্ণনা শেষ করিয়া ভদ্রলোকটি বলিলেন, কিন্তু আমার চরম শিক্ষা হইয়া গেল। কাবুল গিয়াছিলাম টাকা রোজগার করিয়া ইউরোপে পড়িতে যাইবার জন্য। কোন দেশে যাইব বহুদিন মনস্থির করিতে পারি নাই। এই ঘটনার পর নির্ঘ মনে ইংলন্ড বর্জন করিলাম। পড়িতে গেলাম অন্য দেশে ও ফরাসি জাহাজে।
.
চতুরঙ্গ
পুব বাংলা যখন পাকিস্তানের অংশরূপে স্বাধীন হল তখন ওই অঞ্চলের লোক সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারেননি, তাঁহাদের সাহিত্য সৃষ্টি কৃষ্টি গবেষণা কোন পথে চলবে। অখণ্ড পাকিস্তান নির্মাণের সহায়তা করার জন্য তারা উর্দু ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত হবেন, না, যে বাংলা ঐতিহ্য উভয় বাংলা অনুকরণ করছে সেই পন্থা অবলম্বন করবেন? একটু সময় লাগল।
(১) ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার বর্ধমান হাউসে–বাংলা অ্যাকাডেমি। কিছুদিন পরেই তাঁদের প্রথম ত্রৈমাসিক বেরুল। দুই বাংলাতে তখনও পুস্তকাদি অনায়াসে গমনাগমন করত। প্রথম সংখ্যা এ-বাংলায় পৌঁছনোমাত্রই তার আলোচনা দেশ পত্রিকায় বেরোয়। এ-বাংলা তাকে সানন্দ অভিনন্দন জানায়। আজ যদি দুষ্টজন বলে, পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিকরা বাংলা দেশের লোকজনকে অখণ্ড পাকিস্তান ধ্বংস করার জন্য যাবতীয় কারসাজি করছে, তবে অকুণ্ঠ ভাষায় বলব, যখন আমরা দেশ মারফত ওই ত্রৈমাসিককে স্বাগত জানাই তখন আমাদের ভিতর কেউই রাজনৈতিক ছিলেন না। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার তাঁদের পেটুয়া কিছু কিছু বাঙালি মোল্লা মুন্সিকে অ্যাকাডেমিতে ছলে-বলে ঢুকিয়ে দিলেন। তাঁরা বললেন, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলা ভাষায় ইসলামের উত্তম উত্তম আরবি ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ নেই। অতএব আমাদের প্রথম কর্ম কুরান-শরিফের বাংলা অনুবাদ করা। সভাপতি বললেন, সে কী? আমারই জানা-মতে অন্তত পাঁচখানা বাংলা অনুবাদ রয়েছে। মোল্লারা : তা হলে হদিসের (কুরান-শরিফের পরেই হদিস আসে) অনুবাদ করা যাক। আসলে মোল্লারা চান ওই মোকায় বেশ দু পয়সা কামাতে। আর এদিকে বেচারি অ্যাকাডেমি সবে জন্ম নিয়েছে। অজাতশত্রু হতে চায়। স্বীকার করে নিল। সে কর্ম এখনও সমাপ্ত হয়নি। কারণ সমাপ্ত হলেই তো কড়ি বন্ধ হয়ে যাবে। (এ টেকনিক আমাদের এ দেশের ডাঙর ডাঙর আপিসাররাও জানেন।) বাঙলা অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান আমাকে বললেন, এ যাবৎ তেনারা আশি হাজার টাকা গ্যাটস্থ করেছেন। এই মোল্লাদের অনেকেই এখন খানকে সাহায্য করছেন– মীরজাফররূপে।